Image by vectorjuice on Freepik

ঋণের ঘিতে শনির দশা
রিন্টু আনোয়ার

ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবাদটি দেশে খুব পুরনো। এটি এসেছে জড়বাদী চার্বাক দর্শন থেকে। সেখানে বলা আছে-‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং পীবেৎ’। যার অর্থ- ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। এই দর্শনে ধার করে ঘি খাওয়ায় উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণতি বড় ভয়াবহ। কাছের দেশ শ্রীলঙ্কার ‘শিরে সংক্রান্তি’তে পড়া তাজা উদাহরণ। পাকিস্তানও কম ভুগছে না। বাংলাদেশও অনেকটা সেই রথে।

রিজার্ভ কেবলই তলানিতে, রেমিট্যান্স পড়তিতে, টাকা ছাপানোতেও কমতি নেই, বৈদেশিক মুদ্রায় দায় বাড়বাড়ন্ত। গত দেড় দশকে বিদেশী ঋণ ২৯০ শতাংশ বেড়ে ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯৯ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার ৩৭ বছরে (১৯৭২-২০০৯ পর্যন্ত) বিদেশী ঋণ বেড়েছিল আড়াই হাজার কোটি ডলার। আর গত এক যুগে বেড়েছে সাত হাজার ৩৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৭৩ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসে বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার, বা ছয় বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদি।

বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও প্রধান বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ বছরে ভারতের বিদেশী ঋণ প্রায় ৮৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১০১ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সাধারণত, বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৪০ শতাংশের বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের সেই ঝুঁকি ছুঁইছুঁই পর্যায়ে। আগামী বছর থেকে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ আরো বাড়তে থাকবে। ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল বিদেশী ঋণ এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে। যে হারে বিদেশী ঋণ বাড়ছে তা চলতে থাকলে সামগ্রিক আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য মেলানো কঠিন হয়ে পড়বে।

বিদেশী ঋণের সুদ আপাতদৃষ্টিতে কম শোনানো হলেও ডলার ও টাকার বিনিময় হারের হিসাব করলে কার্যকর সুদহার অনেক বেশি। সরকার খামখেয়ালে বা মনের সুখে দেশকে বিদেশী ঋণে আটকিয়েছে, বিষয়টি এমনো নয়। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বিদেশী ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বাড়ায় বিদেশী দায়দেনার বহির্মুখী প্রবাহ আকস্মিকভাবে বাড়তে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ আছে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট শেষেও এর পরিমাণ ২৩.০৯ বিলিয়ন ছিল। অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যেই রিজার্ভ কমেছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে অক্টোবরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে, যার চাপ বাড়িয়েছে ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বর শেষে এটি ছিল ১২.৪৩ বিলিয়ন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। ১০ মাসের ব্যবধানে সেটি প্রায় ৪.২৯ বিলিয়ন ডলার কমেছে। এসব পেমেন্টের মধ্যে ৫২৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে ইন্টারেস্ট হিসেবে। টাকার মান অব্যাহতভাবে কমতে থাকায় ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে ডলার কিনে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে মান আরো কমে যেতে পারে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ঋণ নেয়ার অন্য খরচও বাড়ছে। এখন বৈদেশিক ঋণের ইন্টারেস্টের উপর ২০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। এমনিতেই ঋণের ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে। ট্যাক্সের কারণে আরো অতিরিক্ত ১.৭ শতাংশ যোগ হয়ে নিট ইন্টারেস্ট ১০.২ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। এত ইন্টারেস্ট দিয়ে ঋণ নিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী নন। শুধু ঋণের চাহিদাই নয়, ঋণ আগের মতো পাওয়াও যাচ্ছে না। বিদেশী অনেক ব্যাংকের ঋণ দেয়ার লিমিট কমে গেছে। আগে পুরনো ঋণ শোধ করলে তারা নতুন ঋণ দিত। এখন সেটি হচ্ছে না।

বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশী ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে তথা সেপ্টেম্বরে এসে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ের দিকে মানুষের ঝোঁক বেশি দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে স্থানীয় জরিপে দেখা গেছে, মানুষ এখন সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী বেশি। পিপলস ব্যাংক অব চায়নার করা জরিপে দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় প্রবৃত্তিতে ব্রতী হয়েছেন। এটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের চিত্র। চীনের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিপ বলছে, গত জুন পর্যন্ত এমন প্রবণতা বহাল ছিল। এখনো প্রায় ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, সঞ্চয় করাই বেশি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সাধারণত একজন উপার্জনক্ষম মানুষের ন্যূনতম ছয় মাস চলার মতো অর্থের তহবিল জমা থাকা উচিত। আপদে-বিপদে এটি স্বস্তি দেয়। কিন্তু দেশে দিশেহারা হওয়ার যত ব্যবস্থা আছে, স্বস্তি নেয়ার তা নেই। নিত্যনৈমিত্তিক খরচই যেখানে চলে না, সেখানে সঞ্চয়ের কথা ভাবাই অবান্তর। এতে অনিবার্যভাবে হাত পাতা, ঋণ করার প্রবণতা ভর করেছে সব পর্যায়ে।

এ অবস্থায় সাবধানতা অবলম্বন ও ব্যয় সঙ্কোচন নীতির বিকল্প নেই। নতুন করে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা করে এগোনো দরকার। মনে রাখা দরকার, ওষুধ রোগ সারায়। তেমনি সেই একই ওষুধ মাত্রাছাড়া খেলে তা মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। ধারের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। ঋণ পাওয়া গেলেই যে তা নিতে হবে- এমন কথা নেই। দেখতে হবে, সত্যিই তা প্রয়োজন কি না।

আমরা যদি কৃচ্ছ্রতা সাধন করে, জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে, ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়িয়ে, রফতানি বাড়িয়ে, রেমিট্যান্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারি, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট এবং ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট যদি আনতে পারি, সে ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের পরিমাণ কমে আসবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ টেকসই উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব। এর জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও দৃঢ় পদক্ষেপ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণ করে ঘি খাওয়াটা এক ধরনের উন্মাদনা, এই উন্মাদনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

পরিস্থিতি সরকার ও সাধারণ মানুষকেও চার্বাক দর্শনের ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং পীবে’-বেশ গেলাতে সক্ষম হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংকগুলো বেশ ভালোভাবেই এ তত্ত্ব জনসাধারণকে গেলাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের ঋণ নিন গাড়ি কিনুন, ঋণ নিন বাড়ি কিনুন-ধরনের স্লোগানে মানুষ বেশ প্রলুব্ধ। টাকা নেই তো কী হয়েছে? ব্যাংকের কাছে আসুন। ঋণ নিন, সুদের টাকায় আমাকে ঋদ্ধ করুন। আর ফাঁকে আপনি জীবনকে উপভোগ করুন।
তবে মহাভারতে বকরূপী ধর্মকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, দিনান্তে যে পরম নিশ্চিন্তে শাক-ভাত খায়, সে-ই সুখী। অর্থাৎ, না আছে ঋণ-না আছে সুদ গোনার ঝক্কি। অল্পতে সন্তুষ্টিই আসল কথা। শৈশবের পাঠ্যে ছিল ঋণগ্রস্ত কৃষক গনি মিয়ার পরিণতির কথা। চাণক্য বহু আগে বলে গিয়েছিলেন- ঋণকর্তা পিতা শত্রুর্মাতা চ ব্যভিচারিণী/ভার্যা রূপবতী শত্রুঃ পুত্রঃ শত্রুরপণ্ডিতঃ।

সূত্র: উপসম্পাদকীয়-নয়া দিগন্ত
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্টrintu108@gmail.com
<a href="https://www.freepik.com/free-vector/premium-cash-reward-bonus-work-done-best-employee-rewarding-promotion-order-efficiency-stimulation-boss-subordinate-cartoon-characters_12084769.htm#query=bank%20loan&position=2&from_view=keyword&track=ais&uuid=67cc63a2-bb0e-4f01-b859-dd6be733fcba">Image by vectorjuice</a> on Freepik