সাকিবের বিরুদ্ধে এবার শেয়ার বাজারে কারসাজির অভিযোগ
|হারুন উর রশীদ স্বপন|

সাকিব আল হাসান ক্রিকেটার হিসেবে যতটা নন্দিত, অনাকাঙ্খিত ঘটনা বা কাজের জন্য যেন ততটাই সমালোচিত৷ এবার তার বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে কারসাজির অভিযোগ! এবং কারাসাজিতে তার জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে৷ আর সাকিব এ নিয়ে এখনো মুখ খোলেননি৷ বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷ তবে সাবেক ক্রিকেটাররা বলছেন, এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে বিব্রতকর৷ সাকিবের দেশ ও ক্রিকেটের দিকে খেয়াল রেখে এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত৷

শেয়ার বাজারে সাকিবের ‘কীর্তি’

বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত সাকিব৷ সেই পরিচয় কাজে লাগিয়ে তিনি চলতি বছরের মে মাসে মোনার্ক হোল্ডিংস নামের একটি ব্রোকারেজ হাউসের অনুমোদন নেন৷ মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান সাকিব আল হাসান নিজে৷ এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার ব্যবসায়ী ও সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান৷ প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পদে আবুল খায়ের হিরোর আরো আত্মীয়-স্বজন আছেন৷ শেয়ার বাজার কারসাজিতে আবুল খায়ের হিরো খুব আলোচিত নাম৷

মোনার্ক হোল্ডিংস ২০২১ সাল থেকে সাতটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে পুঁজি বাজার থেকে ৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা তুলে নেয়৷ এই অভিযোগে গত তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়৷

সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওয়ান ব্যাংক, ফরচুন সুজ ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনায় সাকিবের নাম পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-র তদন্ত কমিটি৷ শুধু সাকিবের নামেই এক কোটি চার লাখ শেয়ার লেনদেনের হিসাব পেয়েছেন তারা৷
সাকিব এ বিষয়ে এখনো মুখ না খুলললেও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘এটা ক্রিকেটের বিষয় নয়৷ এটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই৷’’

তার ইমেজের সাথে দেশের ও দেশের ক্রিকেটের ইমেজ জড়িত: জাভেদ ওমর বেলিম

‘অনলাইন জুয়ায়’ জড়ানোর অতীত

সম্প্রতি আরেকটি বিতর্কেও জড়িয়েছিলেন সাকিব৷ গত আগস্টে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনলাইন জুয়ার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের শুভেচ্ছাদূত হয়েছিলেন তিনি৷ এ নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে ক্রিকেট বোর্ড শক্ত অবস্থান নেয়ায় সাকিব বিতর্কিত সেই চুক্তি থেকে সরে আসেন৷ বাংলাদেশের আইনে বেটিং বা অনলাইন জুয়া বেআইনি কাজ৷

ক্রিকেটে জুয়াড়িদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা তাদের কাছ থেকে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও সেই তথ্য গোপন রাখার অপরাধে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে নিষিদ্ধ করে আইসিসি৷ সাকিব নিজেই আইসিসির কাছে তার অপরাধের কথা স্বীকার করেছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত এক বছর নিষেধাজ্ঞা কমে৷

সাকিবের আরো যত কাহিনি

২০১০ সালে বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন দর্শকদের গালাগাল করে ও হুমকি দিয়ে৷ সেটা ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ব্যাটিং করার সময়ের ঘটনা৷

২০১১ সালে বিশ্বকাপে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাজে ইঙ্গিত করেন তিনি৷ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫৮ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ৷ তখন দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার জবাব দেন তিনি মধ্যমা ‘অশ্লীল ভঙ্গিতে’ দেখিয়ে৷

২০১৩ সালে এক দর্শকের কলার চেপে ধরার দৃষ্টান্তও রেখেছেন সাকিব৷ সেই বছরের ২৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলাকালে এক দর্শক সাকিবের কাছে অটোগ্রাফ চাইলে তিনি তার কলার চেপে ধরেন৷

২০১৪ সালে তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন সাকিব৷ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ছক্কা মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দিয়েছিলেন৷ তখন ক্যামেরা দেখে অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত করেন সাকিব৷

একই বছর দর্শক পিটিয়ে সমালোচিত হন তিনি৷ ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে চলাকালে স্ত্রীকে বিরক্ত করার অভিযোগে এক দর্শককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার৷

২০১৫ সালে এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি৷ বিপিএলে সিলেট সুপার স্টার্সের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন রংপুর রাইডার্সের সাকিব৷ তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও গুণতে হয় সেবার৷

২০১৬ সালে আবারও আম্পায়ারের সঙ্গে বিবাদে জড়ান সাকিব৷ বিপিএলের প্রথম কোয়ালিফায়ারে আম্পায়ারের সঙ্গে বিবাদে জড়ান ঢাকা ডায়নামাইটসের অধিনায়ক৷

২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে না চেয়ে সিরিজের আগে ৬ মাসের ছুটি চান সাকিব৷ পরে বোর্ডের মধ্যস্থতায় তিন মাসের ছুটি পান৷

২০১৮ সালে বিসিবির অনাপত্তিপত্র না নিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব৷ তখন ক্রিকেট থেকে ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় তাকে৷

তাকে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, কারণ তাকে বাচ্চারা পর্যন্ত ফলো করে: রাকিবুল হাসান

২০১৯ বিশ্বকাপের দলীয় ফটোসেশনে অনুপস্থিত থেকে সমালোচিত হন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার৷

২০২১ সালে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে নিউজিল্যান্ড সফর থেকে ছুটি নেন৷ এরপর আবার আইপিএল খেলতে ছুটি চান সাকিব৷ তিনি লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ বাদ দিয়ে আইপিএল খেলেন৷

২০২১ সালে অনুশীলনে জৈব সুরক্ষা বলয় ভঙ্গ করেন সাকিব৷ পরে ক্ষমাও চান৷
এছাড়া সাতক্ষীরায় কাঁকড়া খামার দিয়ে কর্মচারীদের বেতন না দিয়ে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন ২০২০ সালে৷

এখানেই শেষ নয়৷ করোনার সময় তিনি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মাস্ক ছাড়াই পাবলিক প্লেসে শো-রুম উদ্বোধন করে সমালোচনার মুখে পড়েন৷

সাবেক ক্রিকেটাররা যা বললেন

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম বলেন, ‘‘সাকিব একজন বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার সন্দেহ নেই৷ তাই তার ইমেজের সাথে দেশের ও দেশের ক্রিকেটের ইমেজ জড়িত৷ তাই আমি মনে করি মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার আরো সংযত হওয়া প্রয়োজন৷”
তিনি বলেন, ‘‘অনেক সুপার স্টার হয়ত মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না৷ তবে ঠিক রাখতে পারার কারণেই শচীন টেন্ডুলকার, মেসিরা নন্দিত৷তাদের লাইফ অনেক কন্ট্রোলড৷ সাকিবের সেই দিকে নজর দেয়া উচিত৷”

জুয়া অনলাইনের সঙ্গে চুক্তি, শেয়ার কারসাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘জুয়ার ব্যাপারে বিসিবি শক্ত অবস্থান নিয়েছে৷ ওটা তো এখন নেই৷ শেয়ার কারসাজিতে সে কতটা জড়িত তা প্রমাণিত নয় এখানো৷ তবে আমি মনে করি, সমালোচনা হয় এমন কাজ থেকে তার বিরত থাকা উচিত৷”

জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রাকিবুল হাসান মনে করেন, ‘‘সাকিবের মতো ক্রিকেটাররা রোল মডেল৷ দেশের মানুষ তাদের ফলো করে৷ তাই তাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে দেশের মানুষ হতাশ হয়৷’’

তিনি বলেন, ‘‘তাকে তো ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে৷ কারণ, তাকে বাচ্চারা পর্যন্ত ফলো করে৷ একজন যত বড় সেলিব্রেটি হবেন. তাকে তত বেশি সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে৷’’