বেতন হাজারে ব্যয় কোটিতে
ইউপি চেয়ারম্যান

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) একজন চেয়ারম্যান সর্বসাকল্যে মাসিক সম্মানী পান ১০ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে তিনি বছরে পান ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আর তা ৫ বছরের কর্মকালে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অথচ একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে স্থানভেদে কোটি টাকার ওপর খরচ করে থাকেন।

এ অর্থের বড় অংশ যায় দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে। আর বাকি অর্থ যায় কর্মী-সমর্থক ও নির্বাচনকালীন নানা কার্যক্রমে। যদিও সরকার থেকে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে জামানত নেওয়া হয়।

তৃণমূলের একজন জনপ্রতিনিধি এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে নির্বাচিত হওয়ার পরই জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম অপরাধে। সাধারণ জনগণের জন্য বরাদ্দ করা সরকারি বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী ও উন্নয়নমূলক কাজ থেকে হাতিয়ে নেন অর্থ।

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও খুব একটা সুফল আসছে না।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘তৃণমূলের নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন আনাসহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়া প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে তা রোধ করা সম্ভব হবে না।

একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে কয়েক বছর আগে থেকেই বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অনুদান দিতে হয়। এরপর নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হলে খরচের পাল্লা ভারী হয়।

আর দলীয় মনোনয়ন পেতে হলে গুনতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। এরপর নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেড়-দুই মাস আগ থেকেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে করা কমিটির কাছে ‘খরচ’ পাঠাতে হয়। দৈনিক প্রতিটি কেন্দ্রে এ খরচের পরিমাণ কমপক্ষে ৫-৭ হাজার টাকা হয়ে থাকে। এরপর নানা ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও প্রচারপত্রের পেছনে খরচ তো আছেই। এ ছাড়া প্রার্থীর নিজস্ব লোকজনের জন্যও একটি বড় পরিমাণের টাকা খরচ করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে জানান, সব কিছু ঠিকঠাক থাকার পরও নির্বাচনে সম্পৃক্ত প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাকে টাকা না দিলে নানা ঝক্কিঝামেলায় পড়তে হয়। তাই এ খাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর নির্বাচন করতে কমবেশি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। এ খরচের টাকা পুষিয়ে নিতে বেশিরভাগ ইউপি চেয়ারম্যান আর সদস্যরা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও অনিয়ম খুব একটা বন্ধ হচ্ছে না।

স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমেই মূলত সরকার তৃণমূল পর্যায়ে সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করে থাকে। সেখানে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি নগদ অর্থ পৌঁছানোর জন্যও স্থানীয় সরকার বিভাগকে এ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এ কাজে সম্পৃক্ত কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য টিআর, কাবিখা বা এলজিএসপি, অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান কর্মসূচি ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দের নগদ টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিধিদের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগের পাহাড় জমছে। আবার স্থানীয় ভুক্তভোগীরাও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে সরাসরি অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের পর তদন্ত করে বিপুলসংখ্যক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বুধন্তি ইউপির চেয়ারম্যান কাজী ছায়িদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছেন পরিষদের ১০ জন মেম্বার (সদস্য)। গত ২৫ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া ওই অনাস্থাপত্র দেওয়া হয়। কাজী ছায়িদুল ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, ১১ টন গম বরাদ্দে অনিয়ম, জন্ম নিবন্ধন ফি ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, জাতীয় সনদ ফি ২০ থেকে ৫০ টাকা, মৃত্যু সনদ ৫০ থেকে ২০০ টাকা করেছেন। এ ছাড়া ওয়ারিশ সনদের জন্য ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন।

একইভাবে গত ৪ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক ইউপি সদস্য অভিযোগ করেন। জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম করে যাচ্ছেন। এরমধ্যে এলজিএসপি-৩, পরিষদের উন্নয়ন সহায়তা, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর, কাবিখা, কাবিটা) অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান কর্মসূচি ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দসহ বিভিন্ন বরাদ্দে ভুয়া বিল ভাউচার ও স্বাক্ষর জাল করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

একইভাবে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদীঘি ইউপির চেয়ারম্যান হেকমত শিকদারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দরা। চেয়ারম্যান হেকমত শিকদারের বিরুদ্ধে কর্মসৃজন প্রকল্পের অতিদরিদ্রদের টাকা আত্মসাৎ, বন বিভাগের জমি দখল করে লেবু ও কলাবাগান তৈরি করা, সাগরদীঘি কলেজের শিক্ষক নিয়োগসহ চাকরি দেওয়ার নামে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ, শাল ও গজারির বন কাটা, সরকারি ভূমি দখলের মতো বিস্তর অভিযোগ আনা হয়।

গত ৭ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬০ টাকা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন ওই ইউপির ৯ মেম্বার। এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দিতে চেয়ে তিন দরিদ্রের কাছ থেকে তিনি ৮৭ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগটি ইউপি মেম্বাররা কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দেন। অভিযোগে বলা হয়, গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়ার কথা বলে ওই ইউপি চেয়ারম্যান তার এলাকার রহম আলীর কাছ থেকে ১২ হাজার, সোহাগ মিয়ার কাছ থেকে ৪৫ হাজার ও আলাল উদ্দিনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েও তাদের ঘর দিতে পারেননি। এ ছাড়া বিভিন্ন রাস্তার মাটি ভরাট না করে টাকা আত্মসাৎ, দরিদ্রদের সেলাই মেশিন বিতরণ না করে টাকা আত্মসাৎ, ভিজিএফ ও জিআর চাল গোপনে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান।

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এ দেশের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে কিছু জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে। মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন করে এ কাজটি করেছেন কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ৮-১০ চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার শ্রীবরদী ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম এলজিএসপি প্রকল্পের ১১ লাখ ৯২ হাজার ৫৯৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া বরগুনা সদর উপজেলার ফুলজুড়ি ইউপির চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউপির চেয়ারম্যান সাজু আহমেদের বিরুদ্ধে ১১১ নারীর সঞ্চয়ের অর্থ আত্মসাৎ, কাবিখা কর্মসূচির ছয় মাসের চাল আত্মসাৎসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সুযোগ পেলেই দুর্নীতি করছে কেউ কেউ। সার্ভিসের (বিভিন্ন সনদ) নামে বেশি টাকা নেওয়া অপরাধ। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এসব ফি সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর বেশি কেন নেবে। এগুলো কঠোরভাবে দমন না করলে হবে না। ’

সূত্রঃ দেশ-রূপান্তর