নিয়ন্ত্রণহীন রাগের অনিয়ন্ত্রিত ধারণা

রাগ হলে তো হলোই। কেউ তো আর রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। মানুষের যে-সব মৌলিক আবেগ রয়েছে, তারমধ্যে একটি আমাদের রাগ। রাগের ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটো দিক রয়েছে। জাতিগত ইতিহাসের ধারায় রাগ অনেক সময় প্রতিবাদের শক্তি জোগায়।

রাগ অনেক সময় ইচ্ছাশক্তিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার উৎসাহ জুগিয়ে যায়। আবার ব্যক্তিগত জীবনে এই রাগের অসহায়তায় সম্পর্ক হয় নষ্ট। আপনার সম্পর্কে মানুষের ধারণা হয় মন্দ। এমনও হতে পারে আপনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরেই করে বসলেন নিজের বা অপরের কোনো ক্ষতি। অনুভূতির এই স্বকীয় রাজত্বে মৌলিক অনুভূতির বৈচিত্র্যতা কি কম অবাক করার?

অবশ্য আধুনিক সময়ে রাগ ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই নেতিবাচক। জাতীয় জীবনেও তা উদ্বেগের কারণ। আমরা সবাই রাগি। রাস্তায় বাজারের বিক্রেতার ওপর রাগ, গাড়ির চালকের ওপর রাগ, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ওপর রাগ আবার আপনিও হয়তো অনেকের বিরাগভাজন নন। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই রাগ খুব খারাপ। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি আমাদের জন্য এখন একটি বড় সমস্যা। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনাকে ব্যক্তি ও মানসিক পর্যায়ে সচেতন হতে হবে। এই সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তো সহজ নয়। তাও নিজেকে জানার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা জরুরি। মূলত আজ রাগ নিয়ে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। রাগ আপনার স্বাভাবিক স্বভাব, এমনটি সবসময় সত্য নয়।

মানুষের দ্রুত রাগের রহস্য কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যারন সেল বলেন, ‘রাগ খুবই জটিল একটি বিষয়। নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করলে বলা যায়, এটি মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত একটি যন্ত্র। আরেকজন ব্যক্তির মাথার ভেতরে ঢুকে নিজেকে ঐ ব্যক্তির কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদ্ধতি। তাদের মন পরিবর্তন করে তাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। বিষয়টির ব্যাপ্তি এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। মন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে মানুষের রাগান্বিত চেহারা।’
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, রাগ হলে মানুষের ভ্রূ বিস্তৃত হয়ে যাওয়া, নাসারন্ধ্র প্রসারিত হওয়া এবং চোয়ালের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার মত পরিবর্তনগুলো মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। এমনটিই প্রফেসর সেল আমাদের জানিয়েছেন। তবে তার বক্তব্য এখানেই শেষ নয়, ‘রাগ হলে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিতে যেসব পরিবর্তন হয়, তার প্রত্যেকটির ফলেই মানুষকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী দেখায়। এই বিষয়গুলো মানুষ শেখে না, বরং জন্মসূত্রে অর্জন করে কারণ, অন্ধ শিশুরাও একই ধরণের ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।’

মানসিকভাবে চটে যাওয়া সমস্যার লক্ষণ

রাগ হয়তো স্বাভাবিক এবং আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিন্তু ঘন ঘন চটে যাওয়া কিংবা রেগে যাওয়া মানসিক সমস্যা। সেই মধ্যযুগ থেকেই অস্তিত্ব সংকটের দার্শনিক ভাবনাপ্রসূত সমস্যা আধুনিক সময়ে মানসিক সংকটের পরিসরে পৌঁছেছে। তাই চটে যাওয়া সমস্যাকে যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

মানসিকভাবে রেগে যাওয়া সমস্যার কিছু প্রাথমিক লক্ষণ হলো:

আপনার রাগের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। রাগ হলে সামাল দিতে তো পারেন না উলটো উদগ্র রাগে ফেটে পড়েন।
নিয়ন্ত্রণহীন আচরণের মধ্যে অভিযোগের পাল্লা থাকে ভারি। তবে আপনি গৃহ সহিংসতায়ও যুক্ত হয়ে যেতে পারেন।
দরকারি কোনো কাজের সময় রাগ আপনাকে ভর করে রাখে বেশি।
মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ বাড়ে তাদেরই যারা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোনোভাবে রাগকে চেপে রেখে চলেছেন।
অনেকে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েন। ভুলে যাওয়ার এই প্রচেষ্টা উলটো ক্ষতি করে।

রাগ হওয়া নিয়ে রয়েছে কিছু ভুল ধারণা

অতিরিক্ত রাগ একটি মানসিক সমস্যা। যখন এটি সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত তখন সঙ্গত কারণেই কিছু ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে এ বিষয়ে। ভ্রান্ত ধারণাগুলো কী? একবার চলুন জেনে নেই।

রাগ প্রকাশ ভালো

অনেকে এই পরামর্শটি দেন সত্য। আর রাগ চেপে রাখাও ঠিক নয় এটিও সত্য। তবে বিষয়টির বিস্তৃত ধারণাটি অনেকের নেই। রাগ প্রকাশ আপনি করবেন। তবে রাগ প্রকাশের ক্ষেত্রে আপনাকে সংযত হতে হবে। এটি একটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনুভূতি তবে নেতিবাচকতার পাল্লা রাগে বেশি। তাই অন্য মানুষের অনুভূতির বিষয়টিও ভাবা জরুরি। নিয়ন্ত্রণ হারানোই মূলত মানসিক সংকট। এজন্য থেরাপি ও কাউন্সেলিং এর আশ্রয় নিতে পারেন।

প্রাতিষ্ঠানিক সফলতায় রাগী ভাব চাই

অনেক সফল ব্যক্তিই প্রতিষ্ঠানে রগচটা বলে পরিচিত। স্টিভ জবসের কথা টেনে এনে প্রায়শই অনেকে বলেন প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যে রাগী অভিব্যক্তি ভাল। এটি ভ্রান্ত ধারণা। স্টিভ জবস স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। তার মানসিক অবস্থা যেহেতু জানার উপায় নেই তাই তার আচরণকে অনুসরণ করার মানে নেই। বিশেষত তার সান্নিধ্য না পেয়ে প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই গলদ থাকে। রাগী অভিব্যক্তি আপনাকে সমীহ আদায় করতে সাহায্য করতেই পারে। শ্রদ্ধা ও সহযোগীতা পাওয়ার হিসেবটি কিন্তু অত সহজ নয়।

জন্মগতভাবেই রাগি, নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না

অনেকেই জন্মগতভাবে রগচটা এমন একটি ধারণা আমাদের সমাজে রয়েছে। এই ধরনের মানুষের রাগ আমরা মেনে চলারই চেষ্টা করি। কিন্তু বিকাশ মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা থাকলে মত পাল্টাতে হয়। কারণ রাগ অনিয়ন্ত্রিত হওয়া কখনই ভালো নয়। রাগ প্রকাশের অনেক উপায় আছে। যিনি গালাগালি উগ্রভাবে করেন তিনি শালীন সীমাতেও রাগ প্রকাশ না করলে তাকে ভালো মানুষ বলা যায় না।

রাগ চেপে রাখাই অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট

অনেকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাউন্সেলিং না নিয়েই বলে ফেলতে পারেন অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট মানেই রাগ চেপে রাখার কৌশল বোঝা। বিষয়টি এত সহজ নয়। রাগ প্রকাশের কৌশল এবং প্রয়োজনে পরিস্থিতি বুঝে রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলের সমন্বয় অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট। তাই কাউন্সেলিং নিন এবং এ বিষয়ে ধারণা নিতে যান।

রাগ ব্যবস্থাপনার কিছু পরামর্শ

অনেক বড় লেখা। তাহলে এবার একটু সমাধানের কথা ভাবা যাক। রাগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তাহলে কী অনুসরণীয়? সেগুলো একটু বোঝাই।

রাগ কমাতে হলে প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকুন। ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ না করে নিজেকে শুধু প্রশ্ন করুন। বিশ্লেষণ করতে গেলে রাগ, অভিমান ও অন্যান্য অনুভূতি আপনাকে ভর করবে। আপনার সহ্যসীমার মাত্রাটুকু বুঝতে হবে। এ জন্য কাউন্সেলিং এর আশ্রয় নিতে পারেন। কারো সঙ্গে মন কষাকষি হলে সাময়িক বিরতি নিতে পারেন তবে আলোচনাসাপেক্ষে।

ঝগড়া কিংবা রাগের পরিস্থিতিতে নিজেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলার পায়তারা মাথায় রাখতে হবে। মনের যত্ন নেয়ার কিছু ব্যায়াম আছে। সেগুলোও করতে পারেন। পেশাদার কারও কাছে সাহায্য নিন, যখন আপনি সংশয় ও অসহায় মনে করবেন নিজেকে। রাগে বীরত্ব নেই। আপনার মানসিক স্বাস্থ্য এই যান্ত্রিক সময়ে মূল্যবান। এক্ষেত্রে গাফিলতির অবকাশ ক্ষীণ।