বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘ক্রাশ নীতি’ নিয়ে বেসরকারি খাতে দরপত্র ছাড়াই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র – Ekush.Info

বহুল আলোচিত রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আর বাড়াবে না সরকার। এসব কেন্দ্র বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত এক দশকে ভাড়াভিত্তিক এসব কেন্দ্রের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এত বছর পরে এসে এখন ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৩৩৭ মেগাওয়াটের বেশি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তবে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ চারটি রেন্টাল কেন্দ্রের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে চায়। এসব কেন্দ্রকে কেন্দ্রের ভাড়া হিসেবে কোনো অর্থ দেওয়া হবে না। যখন বিদ্যুৎ নেবে তখনই শুধু বিদ্যুতের দাম দেবে এমন শর্তে নতুন করে এসব কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে নতুন করে কী ধরনের চুক্তি হতে পারে, তা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চারটি কেন্দ্রের নাম পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। বিইআরসি বলছে, এসব কেন্দ্রের মেয়াদ নবায়নের সুযোগ নেই। তবে নতুন করে চুক্তি হতে পারে কিনা সেটা বিদ্যুৎ বিভাগ ভেবে দেখতে পারে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের সব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মালিকরা নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আমদানি করেনি। অনেকেই উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ুষ্কাল এখনো অন্তত ১০ বছর রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকায় আমদানি করা এসব যন্ত্রপাতি দেশের কল্যাণে ব্যবহার হোক। বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিলে কেন্দ্রগুলোর দামি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে বলেও যুক্তি তাদের।

রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন আমাদের বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা আগের মতো নেই। যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কিছু কেন্দ্র রাখতে হচ্ছে। কারণ বিদ্যুতের ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ ধরে রাখতে গেলে এরকম কিছু ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে। এসব কেন্দ্রের সঙ্গে নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট হিসেবে নতুন করে চুক্তি করা হতে পারে।’

সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১১ এবং ২০১২ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদে উৎপাদনে এসেছিল। ওই তিন ও পাঁচ বছরের মধ্যেই সব কেন্দ্র তাদের বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণসহ মুনাফা তুলে নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা বছর বন্ধ রাখা হলেও ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, সে কারণে এসব কেন্দ্রকে রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র বলা হয়। ফার্নেস তেলে গড়ে ১২ থেকে ১৫ টাকা এবং ডিজেলে গড়ে ২২ থেকে ২৫ টাকা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ পড়ে এইসব কেন্দ্রে।

গত বছরের জুলাইতে মেঘনাঘাটে সামিটের ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ইউনাইটেড পাওয়ারের কেপিসিএল-২ এর ১১৫ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত মাসে বিদ্যুৎ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পিডিবি। একই মাসে মেঘনাঘাটে আইইএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ১০০ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি কেন্দ্রই ফার্নেস তেলভিত্তিক ছিল। এছাড়া বগুড়ায় এনার্জিপ্রিমার ২০ মেগাওয়াটের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকেও বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে পিডিবি।

যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মেয়াদ শেষ-

দেশে বর্তমানে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১২টি। এর সম্মিলিত স্থাপিত ক্ষমতা সাড়ে সাতশ মেগাওয়াট। এর সবগুলোর মেয়াদ আরও প্রায় পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়েছে। তবে কোনোটির সঙ্গে নতুন করে দ্বিতীয় দফায় আবার কোনোটির সঙ্গে তৃতীয় দফায় করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর।

পিডিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, ডাচ-বাংলা পাওয়ারের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ২০১১ সালের ২১ জুলাই উৎপাদনে আসে। তিন বছর মেয়াদে আসা কুইক রেন্টাল এই কেন্দ্রটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। সর্বষেশ চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা গত জুলাই মাসে। তবে পিডিবিরি উৎপাদন তালিকায় এখনো এ কেন্দ্রটি রয়েছে।

দেশে বর্তমানে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১২টি। এর সম্মিলিত স্থাপিত ক্ষমতা সাড়ে সাতশ মেগাওয়াট। এর সবগুলোর মেয়াদ আরও প্রায় পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়েছে। তবে কোনোটির সঙ্গে নতুন করে দ্বিতীয় দফায় আবার কোনোটির সঙ্গে তৃতীয় দফায় করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর।

পিডিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, ডাচ-বাংলা পাওয়ারের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ২০১১ সালের ২১ জুলাই উৎপাদনে আসে। তিন বছর মেয়াদে আসা কুইক রেন্টাল এই কেন্দ্রটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। সর্বষেশ চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা গত জুলাই মাসে। তবে পিডিবিরি উৎপাদন তালিকায় এখনো এ কেন্দ্রটি রয়েছে।

সিনহা পাওয়ারের আমনুরা ৫০ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটি তিন বছরের মেয়াদে উৎপাদনে আসে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। সে হিসেবে কেন্দ্রটি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। সরকার একাধিকবার চুক্তি করে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনার সময় নবায়ন করেছে। কাগজে-কলমে এই কেন্দ্রটির সঙ্গে সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের জানুয়ারিতে।

ভোলায় এগ্রিকোর ৯৫ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটি তিন বছরের চুক্তিতে উৎপাদনে আসে ২০১১ সালের ৩১ মে। সে হিসেবে ২০১৪ সালের মে মাসে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এটিরও দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের মার্চে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা কেন্দ্রটির।

পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য অ্যাক্রন ইনফ্রা সার্ভিসের জুলদার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১২ সালের মার্চ মাসে উৎপাদনে আসে। এই কেন্দ্রটির মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল ২০১৭ সালের মার্চে। নতুন চুক্তির পর কেন্দ্রটির মেয়াদ শেষ হবার কথা আগামী বছরের মার্চে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জে পাওয়ার প্যাকের ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসে ২০১২ সালের মার্চে। কেন্দ্রটি থেকে এখনো বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি। আগামী বছরের মার্চে দ্বিতীয়বার করা নবায়নের তারিখ শেষ হওয়ার কথা এটির। একইভাবে এনপিসিএলের কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালে উৎপাদনে আসার পর সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছরের মে মাসে মেয়াদ শেষ হবে এই কেন্দ্রের।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার সময় দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন গড়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আবাসিক ও শিল্প খাতে তখন ভয়ংকর বিদ্যুৎ সংকট ছিল। রাজধানী ঢাকাতে গড়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার উপরে লোডশেডিং হতো। গ্রামের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘ক্রাশ নীতি’ নিয়ে বেসরকারি খাতে দরপত্র ছাড়াই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমতি দেয়। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তখনকার পরিস্থিতিতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২১ হাজার ৬৯৪ মেগাওয়াট। আর এখন গড়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য, ২০০৯ সালে দেশের ৪৭ ভাগ এলাকা বিদ্যুতের আওতায় ছিল। বর্তমানে দেশের ৯৯ দশমিক ৯৮ এলাকা বিদ্যুতের আওতায়। এসবই সম্ভব হয়েছে দেশে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার ফলে। ইতিমধ্যে পায়রাতে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। এছাড়া আগামীতে উৎপাদনে আসবে ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২৪০০ মেগাওয়াটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মাতারবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াটের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধির নতুন করে সুযোগ নেই। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন উদ্বৃত্ত। ২০২০ সালে বিইআরসি রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা যাবে না জানিয়ে আদেশ দিয়েছে। এই আদেশ বিদ্যুৎ বিভাগকে মানতে হবে। না মানলে তারা আইন অমান্য করবেন, সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’