যৌন নিরাপত্তায় মেয়েরা শুধু নয়, ছেলে শিশুরাও আজ অনিরাপদ। এখন পথশিশুদের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের সূচক দেখলে ভয় লাগে যে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে কি না। শিশুদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত আরবান সংসদীয় ককাসের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের ওপর প্রথম আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন সংসদ সদস্যরা। আজ শনিবার জাতীয় সংসদের এমপি হোস্টেলের এলডি হলে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি আরবান সংসদীয় ককাসের ১০ সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠিত হয়। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেলকে চেয়ারপারসন করে গত ৫ জুন ১২ সদস্যের চূড়ান্ত কমিটি গঠিত হয়। অন্য সদস্যরা হলেন সদস্যসচিব আরমা দত্ত, রুবিনা আক্তার মিরা, আবিদা আনজুম মিতা, সিমিন হোসেন রিমি, জুয়েল আরেং, শবনম জাহান শীলা, শামসুন নাহার, শিরিন আহমেদ, বাসন্তী চাকমা ও হাবিবা রহমান খান।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘এসডিজি সূচক দেখে ভয় লাগে যে আমরা পারব তো এসব পূরণ করতে? আমরা কি সেই জায়গায় যেতে পারব?’ তিনি আরও বলেন, যৌন নিরাপত্তায় শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও একেবারে অনিরাপদ। পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র দরকার। পথশিশু যেন আর তৈরি না হয়, সে জায়গায় কাজ করতে হবে সমন্বিতভাবে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে ককাসের চেয়ারপারসন রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, পথশিশু বেড়ে যাচ্ছে কেন, তা চিহ্নিত করে সমাধান করাই ককাসের কাজ। আর ঢাকায় শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নয়, পথশিশুদের বিনোদনকেও অন্তর্ভুক্ত করতে কাজ করবে ককাস। সরকারি-বেসরকারি সবাইকে নিয়ে আসতে হবে এক জায়গায়।
সভায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ পরিচালক (অপারেশনস) চন্দন জেড গমেজ বলেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এই ককাসের উদ্যোগ নিয়েছে। এই ককাসের লক্ষ্য বাস্তবায়নে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম শর্ত হলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে চলা, যার মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।
সভায় আরবান সংসদীয় ককাস গঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমবিষয়ক তথ্য উপস্থাপন করেন ককাসের সদস্যসচিব আরমা দত্ত।
পথশিশুদের ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দেশে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়।
অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ঢাকার হিসাব অবশ্য তাদের কাছে নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু রয়েছে।
সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। পথশিশুরা ক্ষুধার জ্বালা, একাকিত্বের কষ্ট বা সঙ্গ দোষে নানা ধরনের মাদক নিচ্ছে। এমন এক মাদক ড্যান্ডি। ড্যান্ডি সেবনের বিষয়ে জুরাইনবস্তির পথশিশু মৃদুল বলে, ‘ক্ষুধা লাগে। ড্যান্ডি খেলে ঝিমুনি আসে, ঘুম আসে।
তখন ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে।
পথশিশুদের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ২০১৬ সালে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।
এসব শিশুদের কল্যাণে নেই কোনো নীতিমালা। সরকার ঘোষিত ভিশন ২০৪১ অর্জন করতে হলে এখনই এসব শিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
*ককাস (ইং: Caucus) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বহুল ব্যবহৃত একটি পারিভাষিক শব্দ যার অর্থ হলো কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যকার একটি সুনির্দ্দিষ্ট গোষ্ঠী বা চক্র যেটি বিশেষ একটি বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কার্য সম্পাদনে নিযুক্ত। আদিতে কেবল নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য “ককাস” গঠন করা হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে “ককাস” আছে যারা কোন একটি নির্দ্দিষ্ট বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে। যেমন বাংলাদেশ বিষয়ক ককাস। বর্তমানে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে “ককাস” শব্দটি ব্যবহৃত হয় যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি।