শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় কাদামাটি

বড়রা ভেবে থাকেন, কাদামাটি শুধু শিশুদের নোংরা করে না, রোগ-বালাইও ছড়ায়। কিন্তু শিশুদের চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করা কাদায় রয়েছে তাদের সুস্থ রাখার গুণাগুণ। একটু অবাক লাগলেও এই তথ্য জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ময়লা ছুঁয়ো না বা কাপড়ে ধুলো লাগিও না এ জাতীয় বিধিনিষেধ প্রায় বাবা-মা দিয়ে থাকেন। অথচ পোশাকের জাতকূল অক্ষুণ্ন না থাকলেও ক্ষেত-খামারে দৌড়ে বেড়ানো, গাছে চড়া কিংবা খোলা পরিবেশে খেলাধুলা শিশুর জন্য আশীর্বাদ।

সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বাইরের ময়লা শরীরের প্রয়োজনীয় অণুজীবের সঙ্গে মিশে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি অ্যালার্জি, হাঁপানি, বিষণ্নতা ও উদ্বেগসহ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে দেয়াল তৈরি করে।

মনস্তাত্ত্বিক বিকাশঃ
আমাদের মস্তিস্ক প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকশিত হয় সবচেয়ে বেশি। কেননা মানুষের মনোজগতের বড় অংশ প্রকৃতি দখল করে থাকে। প্রাকৃতিক দৃশ্য মানসিক প্রশান্তিতে সহায়ক; ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত মস্তিষ্ককে সহজেই রিচার্জ করে। ২০০৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মনোযোগ-ঘাটতির (এডিএইচডি) শিকার শিশুরা পার্কে ২০ মিনিটের হাঁটার পরে দ্রুত মনোনিবেশ করতে পারছে। শহরের রাস্তায় ২০ মিনিট হাঁটার চেয়ে ঘাস ও গাছের সান্নিধ্যে থাকাটা তাদের মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। এমন শিশুকে সুস্থ করতে নিরাপদ ও সহজলভ্য এই জাতীয় ‘প্রকৃতির ডোজ’ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন গবেষকরা।

এছাড়া আউটডোর গেম শিশুদের দারুণ দারুণ বিষয় শেখায়। ইতালির পালের্মো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ফ্রান্সেস্কো ভিত্রানো বলেন, কাদা বা বালির মতো উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির খেলনা তৈরির চেষ্টা শিশুদের মস্তিস্কের কার্যকারিতা বিকাশে সাহায্য করে। এ ছাড়া আউটডোর গেম এক ধরনের ব্যায়াম। আর বড় খোলা জায়গায় বিচরণ করলে শক্তি ও সহনশীলতা তৈরি হয়।

অণুজীব শিশুর পুরানো বন্ধুঃ
১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকের ‘হাইজিন হাইপোথিসিস’ গবেষণা অনুসারে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ নানা বিষয় শৈশবের ওপর নির্ভর করে। তখন বলা হয়, শৈশবে অনুজীবের সংক্রমণে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। তবে বর্তমানে অনেক বিজ্ঞানী বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে অণুজীবের সংক্রমণ শিশুদের জন্য উপকারী। যারা ক্ষেত-খামারে বেড়ে উঠে তাদের সাধারণত হাঁপানি, অ্যালার্জি বা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।

সুস্থ শরীর, সুস্থ মনঃ
উপকারী অনুজীব মানসিক চাপ কমিয়ে দিতে সহায়ক। যখন আমরা দুর্বল ও অস্বস্তিবোধ করি, তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা দুর্বল থাকে ও শারীরিক প্রদাহ বাড়ে। যারা শৈশবের বেশির ভাগ গ্রামীণ পরিবেশে কাটিয়েছে, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কাটানোর সুযোগ পায়। শারীরিক সুস্থতা মনকে চাঙা করে, আবার মন ভালো থাকলে আমাদের মস্তিস্ক ও অন্যান্য অঙ্গ বেশ ভালো কাজ করে।

প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বঃ
শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া তৈরির জন্য অনেক বিজ্ঞানী শৈশবে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগকে উৎসাহিত করেছেন। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলার মধ্য দিয়ে এটোপিক ডার্মাটাইটিসে আক্রান্ত শিশু ও কিশোররা সুস্থ হয়ে উঠে। পাতা ও মাটি, বন্ধুত্বপূর্ণ অণুজীবের স্পর্শ ত্বকের মাইক্রোবায়োমকে সমৃদ্ধ করে।

মাটির রান্নাঘরঃ
মাটির রান্নাঘর শিশুদের অতি প্রিয় খেলা। মাটিতে সংসার পেতে মাটি দিয়ে ভাত রান্না, খাবার অভিনয় তাদের আনন্দিত করে। গবেষকরা বলছে, কাদামাটির রান্না করা খুদে এই রাধুনীরা কল্পনাজগতে সৃষ্টিশীল হয়। তারা সক্রিয় ও বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে গড়ে উঠে। তাদের চঞ্চলতা বাড়ে। নিছক খেলা মনে হলেও এই কর্মযজ্ঞ শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণ বাড়ায়।

যান্ত্রিক এই যুগে শিশুরা কাদামাটির স্মৃতি থেকে বহু দূরে। তাদের শরীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকাশের জন্য বিভিন্ন দেশে ডে-কেয়ার সেন্টার ও স্কুলে প্রকৃতির সঙ্গে আনো বেশি সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাঠ্য বইয়ের বাইরের কার্যক্রম বাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়মিত হাঁটা, মাটির রান্নাঘর তৈরিসহ নানা ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে।

বিবিসি অবলম্বনে