এবছর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছিল নেটফ্লিক্সের ডকুমেন্টারি ‘দ্য রোমান্টিকস’। মূলত যশ চোপড়া, আদিত্য চোপড়া ও যশরাজ ফিল্মসের ইতিহাস এবং ভারতীয় সিনেমায় তাদের অবদান নিয়ে নির্মিত এ সিরিজ। বলিউডে সিনেমার বাইরে যশ-আদিত্য চোপড়ার অন্যতম অবদান রোমান্টিক শাহরুখ খান। ডর, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, মোহাব্বতে বা রব নে বানা দি জোড়ির শাহরুখ যশরাজের হাতেই তৈরি। কিন্তু যশরাজকে নিয়ে নির্মিত সে তথ্যচিত্রেই শাহরুখ বলেছিলেন, ‘আমি সবসময় অ্যাকশন সিনেমা করতে চাইতাম।’ রোমান্টিক বয় শাহরুখ অ্যাকশন স্টার হয়ে উঠলেন ২০২৩ সালে, ক্যারিয়ারের ৩০ বছর পার করে। পাঠানের পর জওয়ান সে বার্তা দিল স্পষ্ট করে। পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠলেন সময়ের কণ্ঠস্বর।
জওয়ানের গল্প খুব সাধারণ। কিন্তু অ্যাটলি কুমার এমন নির্মাতা, যিনি সে পরিচিত ধারাকেও দর্শকের কাছে নতুনের মতো করে উপস্থাপন করতে পারেন, ঠিক যেমনটা করতেন বলিউডের নামি পরিচালকরা। সেখানে জওয়ান কোনো না কোনোভাবে অ্যাটলির বিগিল ও থেরির ‘এসেন্স’ রেখেও নতুন হয়ে ওঠে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় চমৎকার স্ক্রিনপ্লে। অ্যাটলি এ সিনেমার ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটিয়েছেন যে দর্শকের অন্যকিছু ভাবার সময় হয় না। স্বল্প সময়ের জন্যও সে চোখ সরাতে পারে না পর্দা থেকে।
শাহরুখ খান একটি সুপারহিরো সিনেমা করেছিলেন ২০১১ সালে। কিন্তু সেটি বলিউড বা ভারতের দর্শকের কাছে গৃহীত হয়নি। ২০২৩ সালে এসে দক্ষিণ ভারতীয় ফ্লেভারে জওয়ান সিনেমায় শাহরুখের সূচনা সিন যেকোনো সুপারহিরো সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। আদিবাসী একটি গোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের দৃশ্যে ব্যান্ডেজ বাঁধা শাহরুখ যেভাবে টিলার ওপর থেকে লাফিয়ে নামেন এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে বিদ্যুচ্চমক দেখা যায় তা শাহরুখকে সুপারহিরোর কাতারেই নিয়ে যায়। কমিক ও মার্ভেলের দর্শক তখন মুন নাইট সিরিজের খোনসুর কথা মনে করতেই পারেন, কিন্তু ফাইট সিকুয়েন্সের পর স্থানীয় দেবতার সামনে দাঁড়ানো শাহরুখকে ‘দেবতা’ বলেই মনে হয়।
এ দেবতার বিষয়ও দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার খুব সাধারণ-পরিচিত (কমন) বিষয়। থালাপতি, থালাইভা বানানো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিটি তাদের নায়কদের দেবতার মতো করেই উপস্থাপন করে। বিশেষত অ্যাকশন হিরোদের। শাহরুখের ক্ষেত্রে মূলত এমন একটি অবতারই প্রয়োজন ছিল। কেননা পাঠান যদিও অ্যাকশন সিনেমা, কিন্তু সেখানে কিছু খামতি ছিল। অ্যাকশন সিকুয়েন্সের তুলনায় সেখানে জাতীয়তাবাদ, রোমান্স. নাচ ও গানের ক্ষেত্রে জোর দেয়া হয়েছিল বেশি। জওয়ানে ছিল একের পর এক অ্যাকশন সিকুয়েন্স এবং বিশেষ করে অনেকগুলো শাহরুখ।
সিনেমায় মূল শাহরুখ দুজন—একজন আজাদ, অন্যজন বিক্রম রাথোর। পিতা ও পুত্র। বিক্রমের পুত্র আজাদ। জেলার আজাদ তার জেলে থাকা ছয়জন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করে। যে দুর্নীতির বিচার রাষ্ট্র করে না, তা আজাদ করে। বলিউডের শাহেনশাহ বা অন্য কোনো সিনেমার সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায়। তার চেয়ে বড় করে বলা যায়, শাহরুখ এখানে হয়ে উঠলেন গথামের ব্যাটম্যান। ভেঙে পড়া শহর নয়, ঘুণ ধরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে সে। সিনেমায় উঠিয়ে আনা হয়েছে এমন কিছু ঘটনা, যা দর্শককে মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্রের চলমান অবস্থাকে। মূল গল্পের পাশে রাখা হয়েছে হরিয়ানার কৃষকের আত্মহত্যা, গোরখপুরের হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি, সেনাবাহিনীর হাতে যাওয়া ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্র ও নির্বাচনে ব্যবহার হওয়া কালো টাকা। সিনেমাটি তাই একসময় হয়ে ওঠে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
অ্যাকশন-প্যাকড এন্টারটেইনার জওয়ানে শাহরুখ খানকে দেখা গেছে অন্তত আধ ডজন লুকে। দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ট্রেন ডাকাত হিসেবে তার টাক মাথা লুক নিয়ে ইন্টারনেট সরব ছিল অনেক আগে থেকেই। এরপর সয়লাব হয়েছে মুখে সিগার নিয়ে বেল্ট দিয়ে খলনায়ক পেটানোর দৃশ্য। সিনেমায় আজাদ চরিত্রে অভিনয় করা শাহরুখ একজন নীতিবান পুলিশ অফিসার। পাশাপাশি একজন দায়িত্ববান সন্তান ও চমৎকার প্রেমিক। এ শাহরুখ মনে করিয়ে দেয় যশরাজ বা করণ জোহরের রাহুল ও রাজকে। পাশাপাশি আজাদের আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটি ইঙ্গিত দেয় নতুন এক অ্যাকশন অবতারের। কিন্তু আজাদকে ছাপিয়ে যায় বিক্রম রাথোর।
আজাদের পিতা বিক্রম রাথোরের নেপথ্য গল্প দর্শককে আবেগতাড়িত করবে। আর এ চরিত্রে শাহরুখের লুক ও সোয়্যাগ তাদের শিস বাজাতে বাধ্য করেছে। বিনয়বশত শাহরুখ নিজে হয়তো মানবেন না, কিন্তু তিনি বুড়ো বিক্রমের চরিত্রে নিজেকে নিয়ে গেছেন রজনীকান্তের কাতারে। বলিউড নয়, দক্ষিণ নয়, তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় সিনেমার দর্শকের প্রিয় সোয়্যাগ দেখানো চরিত্র।
সিনেমার অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা শাহরুখের এ পারফরম্যান্সে ফিকে হয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু অ্যাটলির গল্প সাজানোর কারণে তা হয়নি। নয়নতারা তার চরিত্রে শাহরুখের পাশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। নিজেদের উপস্থিতি ও অভিনয় ক্ষমতা প্রমাণ করেছেন সানিয়া মালহোত্রা, প্রিয়ামনি ও ঋধি ডোগরা। কয়েক মিনিটের ক্যামিওতে দীপিকা পাড়ুকোন শাহরুখের বিক্রম চরিত্রের সঙ্গে যে রোমান্স করেছেন তা আজাদ-নর্মদাকে ছাড়িয়ে যায়। খল চরিত্রে বিজয় সেতুপতি দুর্দান্ত, কিন্তু কিছুটা বোধহয় টাইপড হয়ে গেলেন শাহরুখের বিপরীতে। কিন্তু যা করেছেন, তা-ই একটা বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে।
বলিউড ও ভারতীয় সিনেমায় জওয়ান হয়ে উঠতে পারে ‘ট্রেন্ড সেটার’। কেননা বহুদিন পর একজন অভিনেতা সিনেমায় কেবল দর্শক নয়, মানুষকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি কথা বলেছেন। সত্যিকারের নায়ক হয়ে উঠেছেন শাহরুখ। হয়ে উঠেছেন একটি কণ্ঠস্বর।