ঢাকার চলতি এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি। ওয়েটার জিজ্ঞেস করলেন, মুরগির আইটেম কোনটা খাব। বয়লার, নাকি দেশি? উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা ভালো হবে? উত্তর পেলাম, দেশি। অর্ডার করলাম। খেয়ে তেমন আলাদা করতে পারলাম না। বয়লার যেমন লাগে, দেশিটার স্বাদও তেমনি। শুধু দেশিটায় মাংসের পরিমাণ কম।

দেশি মুরগির সঙ্গে পার্থক্য যা পেলাম, সেটা হলো দামে বেশি। একই খাবার বাজারে কোনোটা অর্গানিক, কোনোটা চাষের বলে বিক্রি হয়। মাছের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। চাষের পাঙাস যেমন সহজে পাওয়া যায়, দামে যেমন সস্তা, দেশি পাঙাসের দাম সেখানে প্রায় এর ছয়-সাত গুণ। দামে অনেক বেশি, স্বাদেও নাকি এর তুলনা হয় না। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ খাবারটা খান পুষ্টির জন্য, তাই এটা যাচাই করা দরকার, অর্গানিক খাবার কি চাষ করা খাবার থেকে বেশি পুষ্টিকর?

অর্গানিক খাবারের দাম বেশি হওয়ার কিছু কারণ আছে। অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া আলাদা।
মানে ভালো, দামে বেশি কেন
পুষ্টির প্রশ্নে যাওয়ার আগে আমরা দেখি, অর্গানিক খাবার কি স্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি সুবিধা দেয়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আপনার বাজেটে অর্গানিক খাবার না থাকে, তবে চিন্তার কিছু নেই। কারণ সাধারণ খাবার থেকেও আপনি একই ধরনের পুষ্টিগুণ পাবেন। অর্গানিক কিনা, তা নিয়ে ভাবার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাজারের তালিকায় প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি আছে কিনা। আপনি দেশি মুরগির ডিম খান বা ফার্মের মুরগির ডিম, তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পুষ্টিগুণ সমান।
অর্গানিক খাবারের দাম বেশি হওয়ার কিছু কারণ আছে। অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া আলাদা। অর্গানিক ফসলগুলো সিন্থেটিক কীটনাশক ও বেশিরভাগ আগাছানাশক ব্যবহার না করে উৎপাদন করতে হয়। এ ছাড়া মাংস, পোল্ট্রি, দুধ ও ডিমের মতো পশুজাত পণ্য এমন প্রাণী থেকে আসতে হয়, যেগুলো সারা বছর বাইরে থাকে, মাঠেঘাটে চড়ে বেড়ায়। কোনো গ্রোথ হরমোন বা অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না। তাই এগুলো উৎপাদন করতে বেশি শ্রম ও বেশি সময় প্রয়োজন। যেমন আগাছানাশক ব্যবহার না করলে ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করার জন্য আলাদা শ্রমিক নিয়োগ করা লাগতে পারে।

বেশি দাম মানেই কি বেশি পুষ্টি
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের পুষ্টি বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক লিজি ডেভিস বলেছেন, ‘প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের মতো ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টের ক্ষেত্রে অর্গানিক ও প্রচলিত খাবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
কিছু গবেষণায় ভিটামিন, খনিজ এবং নির্দিষ্ট অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য দেখা গেছে। যেমন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অর্গানিক ভুট্টায় বাজারে প্রচলিত চাষের ভুট্টার চেয়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বেশি থাকতে পারে।
তবে ডেভিস বলেছেন, ‘এই গবেষণাগুলোর ফলাফল অসামঞ্জস্যপূর্ণ। গবেষকেরা এখনো প্রমাণ করতে পারেননি যে, এই মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পার্থক্যগুলো স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট কিনা। এই গবেষণাগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন, বড় পরিসরে এগুলো যাচাই করে দেখা হয়নি। অধিকাংশ বড় বিশ্লেষণই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।’
২০১৮ সালে ফ্রান্সের প্রায় ৭০ হাজার প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত অর্গানিক খাবার খেয়েছেন, তাঁদের ক্যান্সার নির্ণয়ের হার ২৫ শতাংশ কম ছিল।

অর্গানিক খাবার কি রোগের ঝুঁকি কমায়
অর্গানিক খাবারের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে গবেষণাগুলোতে মিশ্র ফলাফল দেখা গেছে। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের প্রায় ৭০ হাজার প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত অর্গানিক খাবার খেয়েছেন, তাঁদের ক্যান্সার নির্ণয়ের হার ২৫ শতাংশ কম ছিল। কিন্তু এর কয়েক বছর আগে ব্রিটেনে প্রায় ৬ লাখ ২৩ হাজার মধ্যবয়সী নারীর ওপর করা একটি গবেষণায় অর্গানিক এবং প্রচলিত খাবার গ্রহণকারীদের মধ্যে ক্যান্সারের হারে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
এ ধরনের পরস্পরবিরোধী ফলাফলের একটি ব্যাখ্যা হলো, যারা নিয়মিত অর্গানিক খাবার খান, তাঁদের সাধারণত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা থাকে। তাঁদের আয়ও বেশি। তাই কেবল অর্গানিক খাবারই স্বাস্থ্যের এই ফলাফলগুলোর কারণ, এমনটা বলা যায় না। এই গবেষণাগুলো মানুষের স্মৃতির ওপরও নির্ভর করে। আমরা মাস বা বছর ধরে কী খেয়েছি, সেটা আসলে লম্বা সময় ধরে মনে রাখা কঠিন।
অন্যান্য গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দেয়, অর্গানিক খাবার খাওয়া ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং হৃদরোগের কম ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। তবে সেগুলো প্রমাণিত হয়নি।

দাম দিয়ে কি অর্গানিক খাবার খাওয়া উচিত
বিভিন্ন জরিপ বলে, প্রচলিত খাবারে কীটনাশকের মিশ্রণ আছে বলেই মানুষ এটি নিয়ে উদ্বেগে থাকে। আসলে অর্গানিক খাবারও সম্পূর্ণ কীটনাশকমুক্ত নয়। কারণ, অর্গানিক কৃষকেরাও কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন বা বিভিন্ন উৎস থেকে কীটনাশক এসব খাবারে মিশতে পারে।
প্রচলিত খাবার খাওয়ার সময় আমরা যে পরিমাণ সিন্থেটিক কীটনাশকের সংস্পর্শে আসি, তা আমাদের ক্ষতি করতে পারে বলে বর্তমানে গবেষকদের হাতে এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। তবে এর মানে এই না যে কীটনাশকগুলো ক্ষতিকর নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কৃষি শ্রমিক নিয়মিত উচ্চ মাত্রার কীটনাশকের সংস্পর্শে আসেন, তাদের পারকিনসনস রোগ এবং কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি হতে পারে।
কেউ কেউ জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও এড়াতে অর্গানিক খাবার পছন্দ করেন। তবে স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো ঝুঁকি তৈরি করে, এমন প্রমাণ খুবই কম।
মোদ্দাকথা হলো, কীটনাশকের সংস্পর্শ কমানোর ইচ্ছা মানুষের থাকতেই পারে। শুধু নিজের স্বাস্থ্যের জন্যই না, কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেউ যদি অর্গানিক খাবার কিনতে না পারেন, তবে একটা বুদ্ধি করা যেতে পারে। যে খাবারগুলো আমরা সবচেয়ে বেশি খাই, সেগুলোর অর্গানিক সংস্করণ কেনার কথা ভাবা যেতে পারে। তাজা ফল ও সবজি প্রবাহিত পানিতে বা ট্যাপ ছেড়ে ধোয়া যেতে পারে। ডলে ডলে এগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করলে পৃষ্ঠে লেগে থাকা রাসায়নিকের মাত্রা কমানো সম্ভব। কীটনাশক মাঝেমধ্যে মাংস ও পোল্ট্রির চামড়া বা ফ্যাটে জমা হয়। তাই এই অংশগুলো বাদ দিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
আসলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো পুষ্টিকর খাবারের ওপর জোর দেওয়া। যেমন ফল, সবজি, শস্য এবং প্রক্রিয়াজাত করা হয়নি এমন খাবার খাওয়া উচিত। এগুলো অর্গানিক হোক বা না হোক, বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যতালিকাই আসল। এর পক্ষে গবেষকদের কাছে যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ আছে।