চেক প্রত্যাখ্যান মামলায় হাইকোর্টের ৫ নির্দেশনা

ঢাকা: চেক প্রত্যাখানের মামলা বিচারের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতকে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।

চেক প্রত্যাখ্যানকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি, জরিমানার বিধান রাখা ‘দ্য নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট, ১৯৮১’-এর ১৩৮ ধারা দেশি-বিদেশি আইন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

আর এ ধারাটি বাতিলের আগ পর্যন্ত চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা বিচারের ক্ষেত্রে ৫ দফা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

চলতি বছরের ৮ আগস্টে দেওয়া চেক প্রত্যাখ্যানের এক মামলায় দণ্ডিত আসামির আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

সম্প্রতি ৫৪ পৃষ্ঠার এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

যদিও রায়টি আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত স্থগিত করেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ায় এখন এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে) দায়ের করবে।

২০১০ সালে চেক প্রত্যাখ্যানের অভিযোগে টাঙ্গাইল আদালতে এ মামলা হয়। মামলার বিচার শেষে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিকে দুই মাসের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ ৭৪ হাজার ৩০৫ টাকা অর্থ দণ্ড দেন। এর বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করেন।

হাইকোর্ট আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থদণ্ড স্থগিত করে আপিলকারীকে জামিন দেন।

এর মধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে আপস হয়। সেই আপসনামা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। শুনানি শেষে চলতি বছরের ২৮ আগস্ট আপিল নিষ্পত্তি করে ৫ দফা নির্দেশনা দেন।

আদালতে বাদীপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. আশরাফুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আশেক মমিন।

রায়ে বলা হয়েছে, দ্য নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট , ১৯৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযাযী জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আদালতের বিবেচনার ওপর নির্ভর করে। এই বিবেচনা প্রয়োগ করতে গিয়ে বিচারিক আদালতগুলো যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে, এটি স্পষ্ট। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বিচারিক আদালত একই রকম দণ্ড দিতে পারে, যা আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়। তাই বিচারিক আদালতের ‘বিবেচনা’ প্রয়াগের ক্ষেত্রে নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

১. মামলা হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে চেক প্রদানকারী যদি চেকে বর্ণিত বা উল্লেখিত টাকা চেক গ্রহীতাকে দিতে চান, তবে বিচারিক আদালত চেকে উল্লেখিত টাকা এবং মামলার যাবতীয় খরচ যোগ করে জরিমানা (ক্ষতিপূরণ) চেক গ্রহণকারীকে দেবেন।

২. চেক প্রদানকারী যদি মামলা হওয়ার ৩ মাস পর কিন্তু ৬ মাসের আগে চেক গ্রহীতাকে চেকে বর্ণিত বা উল্লেখিত টাকা দিতে চান, তবে চেকে উল্লেখিত টাকার সমপরিমাণ টাকা মামলার খরচ হিসেবে যোগ করে জরিমানা দিতে হবে।

৩. যদি চেক প্রদানকারী চেকে বর্ণিত বা উল্লেখিত সমুদয় টাকা মামলা হওয়ার ৬ মাস পর কিন্তু ১ বছর আগে দিতে চান, তবে আদালত চেক প্রদানকারীকে চেকে উল্লেখিত টাকা ও উল্লেখিত টাকার আড়াই গুণ জরিমানা হিসেবে দিতে হবে।

৪. যদি চেক প্রদানকারী সমুদয় টাকা মামলা হওয়ার ১ বছর পর কিন্তু ২ বছরের আগে দিতে চান, তবে চেকে উল্লেখিত টাকা ও উল্লেখিত টাকার তিনগুণ টাকা জরিমানা দিতে হবে চেক প্রদানকারীকে।

৫. মামলা হওয়ার ২ বছর পরও যদি চেক প্রদানকারী টাকা না দেন, সেক্ষেত্রে আদালত চেকে উল্লেখিত বা বর্ণিত টাকার ৩ গুণ এবং আদালদত মনে করলে চেক প্রদানকারীকে ১ বছর পর্যন্ত সাজা দিতে পারবেন।

এসব নির্দেশনার পর রায়ে বলা হয়েছে, চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় চেকে বর্ণিত টাকা ও জরিমানার টাকা দুটি আলাদা বিষয়। চেকে বর্ণিত টাকা হলো চেকের ওপর লিখিত টাকার পরিমাণ। অপরদিকে জরিমানার টাকা হলো চেক প্রত্যাখ্যানের অপরাধের কারণে আদালতের আরোপ করা জরিমানা। ভুক্তোভোগী শুধু চেকে উল্লেখিত টাকা পেলে তার মামলার খরচ এবং সময়ক্ষেপণের কোনো মূল্যই পাবেন না। ফলে চেকে উল্লেখিত টাকাসহ জরিমানা চেক গ্রহীতাকে দিতে প্রত্যেকটি আদালতের রায়ের শেষে লিখতে হবে- ‘চেকে উল্লেখিত টাকা এবং অত্র রায়ে বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ী ও ধারা ১৩৮ এর উপধারা (২)-এ প্রদত্ত সীমা পর্যন্ত জরিমানার টাকা বাদীপক্ষ প্রাপ্ত হবেন।

রায়ে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে প্রতিস্থাপিত ‘দ্য নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট , ১৯৮১’-এর ধারা ১৩৮ দেওয়ানি কার্যবিধির ৫৫ ধারা থেকে ৫৯ ধারা, ইন্টারন্যাশনাল কোভিন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’র ১১ অনুচ্ছেদ এবং আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শুধু তাই না, এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা উন্নত বিশ্বের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার পথেও বাধা। যে কারণে মহামান্য জাতীয় সংসদ ধারাটি বাতিলের দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে উচ্চ আদালত আশা পোষণ করছে। ধারাটি বাতিলের আগ পর্যন্ত এসব নির্দেশনা অনুসরণ করে বিচারিক আদালত রায় দেবেন।

এ রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। গত ৬ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম রায়টি স্থগিত করেন।

এ বিষয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল আলম জনান, রায়টি এখন স্থগিত রয়েছে। আগামী সপ্তাহে এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করা হবে।