১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৮:৩৬:৩২
মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো দাম্পত্যজীবন। এটি কেবল সামাজিক বা জৈবিক প্রয়োজন নয়; বরং মানবতার, ভালোবাসার ও প্রশান্তির এক পবিত্র প্রতিষ্ঠান। কুরআন মজিদ দাম্পত্যজীবনকে ইবাদতের পর্যায়ে উন্নীত করেছে, যেখানে ভালোবাসা, দয়া, দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পারস্পরিক শান্তি ও সন্তুষ্টি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।”
— (সুরা রূম ৩০:২১)
এই আয়াতটি দাম্পত্যজীবনের মূল দর্শন প্রকাশ করে। এখানে তিনটি মূল শব্দ এসেছে —
এর অর্থ, আল্লাহর ইচ্ছায় স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। সম্পর্কের মূলভিত্তি কেবল পার্থিব আকর্ষণ নয়, বরং আত্মিক শান্তি ও পারস্পরিক মমতা।
কুরআন ঘোষণা করে—
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই প্রাণ থেকেই তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন…”
— (সুরা নিসা ৪:১)
এই আয়াত প্রমাণ করে, নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারও ঊর্ধ্বে নয়। ইসলাম নারীকে কোনোভাবেই গৌণ বা পরাধীন করেনি; বরং দাম্পত্য সম্পর্কে উভয়ের সমান মর্যাদা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে।
কুরআনের আরেকটি অনন্য উপমা—
“তারা তোমাদের পোশাক, আর তোমরা তাদের পোশাক।”
— (সুরা বাকারা ২:১৮৭)
পোশাক দেহের আড়াল, সৌন্দর্য, ও সুরক্ষার প্রতীক।
তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের রক্ষা, সম্মান ও আশ্রয়।
এই আয়াতে দাম্পত্যজীবনের গভীর আত্মিক সম্পর্কের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে — যেখানে উভয়েই একে অপরের জন্য অপরিহার্য ও পরিপূর্ণতার অংশ।
আল্লাহ বলেন—
“তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সুন্দরভাবে সহবাস করো।”
— (সুরা নিসা ৪:১৯)
এখানে “মা‘রূফ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ — ন্যায়ের সাথে, সৌন্দর্যের সাথে, ভদ্রতা ও সম্মানের সাথে।
অর্থাৎ, দাম্পত্যজীবনে কেবল ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আচরণে শালীনতা ও সহনশীলতা।
যে পরিবারে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও কোমলতা থাকে, সেই পরিবারেই আল্লাহর রহমত নেমে আসে।
কুরআন বলে—
“স্ত্রীরাও স্বামীর প্রতি একইভাবে অধিকার রাখে, যেমন স্বামীদেরও রয়েছে তাদের প্রতি — ন্যায়ের সাথে।”
— (সুরা বাকারা ২:২২৮)
ইসলাম দাম্পত্যজীবনে পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
স্বামী যেমন স্ত্রীর নিরাপত্তা, ভরণপোষণ ও সম্মান রক্ষা করবে —
তেমনি স্ত্রীও স্বামীর প্রতি আনুগত্য, সহযোগিতা ও যত্ন প্রদর্শন করবে।
উভয়ের মধ্যে ন্যায়, বিশ্বাস ও পরামর্শ থাকলেই সম্পর্ক স্থায়ী হয়।
কুরআনের ভাষায়—
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।”
— (সুরা তাহরিম ৬:৬)
দাম্পত্যজীবনের মূল দায়িত্ব শুধু অর্থ উপার্জন নয়, বরং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব।
স্বামীকে পরিবারকে সৎপথে পরিচালনা করতে হবে, স্ত্রীকেও সন্তানদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।
এভাবে পরিবারই হয়ে ওঠে ঈমান ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“শুদ্ধ নারীরা শুদ্ধ পুরুষদের জন্য, আর শুদ্ধ পুরুষরা শুদ্ধ নারীদের জন্য।”
— (সুরা নূর ২৪:২৬)
এই আয়াত দাম্পত্য নির্বাচনে নৈতিকতা ও চরিত্রের গুরুত্ব প্রকাশ করে।
শুধু রূপ বা সম্পদ নয়, বরং ধর্মীয় ও নৈতিক সামঞ্জস্য হলো সুখী দাম্পত্যের ভিত্তি।
বিষয় | কুরআনিক শিক্ষা |
---|---|
দাম্পত্যের উদ্দেশ্য | প্রশান্তি, ভালোবাসা ও দয়া |
সম্পর্কের রূপ | পরিপূরকতা ও আস্থা |
আচরণের নীতি | ন্যায়ের সাথে সহাবস্থান |
দায়িত্ব | পারস্পরিক সম্মান ও দায়িত্ব ভাগাভাগি |
আধ্যাত্মিক দিক | পরিবারকে সৎপথে রাখার দায়িত্ব |
নির্বাচনের মানদণ্ড | চরিত্র ও ধর্মীয় সামঞ্জস্য |
দাম্পত্যজীবন ইসলামে কেবল একটি চুক্তি নয়, বরং এক পবিত্র অঙ্গীকার।
এটি ভালোবাসা, দায়িত্ব, সহনশীলতা ও ত্যাগের সমন্বয়ে গঠিত।
যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পোশাক, প্রশান্তির আশ্রয় এবং আখিরাতের সঙ্গী।
কুরআন শেখায় —
👉 ভালোবাসায় দয়া থাকতে হবে,
👉 দয়ায় ন্যায় থাকতে হবে,
👉 আর ন্যায়ে থাকতে হবে আল্লাহভীতি।
যে পরিবারে এই তিনের সমন্বয় ঘটে, সেই পরিবারই হয় জান্নাতের ছায়া।