ধর্ম

দাম্পত্যজীবন নিয়ে কোরআনের বাণী ও বিশ্লেষণ

  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৮:৩৬:৩২

🕊️ দাম্পত্যজীবন নিয়ে কোরআনের বাণী ও বিশ্লেষণ

ভূমিকা

মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো দাম্পত্যজীবন। এটি কেবল সামাজিক বা জৈবিক প্রয়োজন নয়; বরং মানবতার, ভালোবাসার ও প্রশান্তির এক পবিত্র প্রতিষ্ঠান। কুরআন মজিদ দাম্পত্যজীবনকে ইবাদতের পর্যায়ে উন্নীত করেছে, যেখানে ভালোবাসা, দয়া, দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পারস্পরিক শান্তি ও সন্তুষ্টি।


🌸 কুরআনের দৃষ্টিতে দাম্পত্যজীবনের উদ্দেশ্য

আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।”
(সুরা রূম ৩০:২১)

এই আয়াতটি দাম্পত্যজীবনের মূল দর্শন প্রকাশ করে। এখানে তিনটি মূল শব্দ এসেছে —

  • সাকিনাহ (প্রশান্তি)
  • মওদ্দাহ (ভালোবাসা)
  • রহমাহ (দয়া)

এর অর্থ, আল্লাহর ইচ্ছায় স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। সম্পর্কের মূলভিত্তি কেবল পার্থিব আকর্ষণ নয়, বরং আত্মিক শান্তি ও পারস্পরিক মমতা।


🌿 নারী-পুরুষের পারস্পরিক মর্যাদা ও উৎস

কুরআন ঘোষণা করে—

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই প্রাণ থেকেই তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন…”
(সুরা নিসা ৪:১)

এই আয়াত প্রমাণ করে, নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারও ঊর্ধ্বে নয়। ইসলাম নারীকে কোনোভাবেই গৌণ বা পরাধীন করেনি; বরং দাম্পত্য সম্পর্কে উভয়ের সমান মর্যাদা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে।


🌷 পারস্পরিক ভালোবাসা ও রক্ষার প্রতীক

কুরআনের আরেকটি অনন্য উপমা—

“তারা তোমাদের পোশাক, আর তোমরা তাদের পোশাক।”
(সুরা বাকারা ২:১৮৭)

পোশাক দেহের আড়াল, সৌন্দর্য, ও সুরক্ষার প্রতীক।
তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের রক্ষা, সম্মান ও আশ্রয়
এই আয়াতে দাম্পত্যজীবনের গভীর আত্মিক সম্পর্কের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে — যেখানে উভয়েই একে অপরের জন্য অপরিহার্য ও পরিপূর্ণতার অংশ।


🌺 আচরণে ন্যায় ও সৌন্দর্য

আল্লাহ বলেন—

“তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সুন্দরভাবে সহবাস করো।”
(সুরা নিসা ৪:১৯)

এখানে “মা‘রূফ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ — ন্যায়ের সাথে, সৌন্দর্যের সাথে, ভদ্রতা ও সম্মানের সাথে।
অর্থাৎ, দাম্পত্যজীবনে কেবল ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আচরণে শালীনতা ও সহনশীলতা
যে পরিবারে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও কোমলতা থাকে, সেই পরিবারেই আল্লাহর রহমত নেমে আসে।


🌼 দায়িত্ব ও অধিকার

কুরআন বলে—

“স্ত্রীরাও স্বামীর প্রতি একইভাবে অধিকার রাখে, যেমন স্বামীদেরও রয়েছে তাদের প্রতি — ন্যায়ের সাথে।”
(সুরা বাকারা ২:২২৮)

ইসলাম দাম্পত্যজীবনে পারস্পরিক দায়িত্বঅধিকারের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
স্বামী যেমন স্ত্রীর নিরাপত্তা, ভরণপোষণ ও সম্মান রক্ষা করবে —
তেমনি স্ত্রীও স্বামীর প্রতি আনুগত্য, সহযোগিতা ও যত্ন প্রদর্শন করবে।
উভয়ের মধ্যে ন্যায়, বিশ্বাস ও পরামর্শ থাকলেই সম্পর্ক স্থায়ী হয়।


🌸 পারিবারিক নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব

কুরআনের ভাষায়—

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।”
(সুরা তাহরিম ৬:৬)

দাম্পত্যজীবনের মূল দায়িত্ব শুধু অর্থ উপার্জন নয়, বরং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব
স্বামীকে পরিবারকে সৎপথে পরিচালনা করতে হবে, স্ত্রীকেও সন্তানদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।
এভাবে পরিবারই হয়ে ওঠে ঈমান ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।


🌼 চরিত্র ও মানসিক সামঞ্জস্যের গুরুত্ব

আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“শুদ্ধ নারীরা শুদ্ধ পুরুষদের জন্য, আর শুদ্ধ পুরুষরা শুদ্ধ নারীদের জন্য।”
(সুরা নূর ২৪:২৬)

এই আয়াত দাম্পত্য নির্বাচনে নৈতিকতা ও চরিত্রের গুরুত্ব প্রকাশ করে।
শুধু রূপ বা সম্পদ নয়, বরং ধর্মীয় ও নৈতিক সামঞ্জস্য হলো সুখী দাম্পত্যের ভিত্তি।


🌿 কুরআনিক শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা

বিষয় কুরআনিক শিক্ষা
দাম্পত্যের উদ্দেশ্য প্রশান্তি, ভালোবাসা ও দয়া
সম্পর্কের রূপ পরিপূরকতা ও আস্থা
আচরণের নীতি ন্যায়ের সাথে সহাবস্থান
দায়িত্ব পারস্পরিক সম্মান ও দায়িত্ব ভাগাভাগি
আধ্যাত্মিক দিক পরিবারকে সৎপথে রাখার দায়িত্ব
নির্বাচনের মানদণ্ড চরিত্র ও ধর্মীয় সামঞ্জস্য

উপসংহার

দাম্পত্যজীবন ইসলামে কেবল একটি চুক্তি নয়, বরং এক পবিত্র অঙ্গীকার।
এটি ভালোবাসা, দায়িত্ব, সহনশীলতা ও ত্যাগের সমন্বয়ে গঠিত।
যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পোশাক, প্রশান্তির আশ্রয় এবং আখিরাতের সঙ্গী।

কুরআন শেখায় —
👉 ভালোবাসায় দয়া থাকতে হবে,
👉 দয়ায় ন্যায় থাকতে হবে,
👉 আর ন্যায়ে থাকতে হবে আল্লাহভীতি।

যে পরিবারে এই তিনের সমন্বয় ঘটে, সেই পরিবারই হয় জান্নাতের ছায়া।

আরও খবর