উত্তরায় গার্ডার চাপায় মৃত্যু

নবদম্পতির মুখে বেঁচে ফেরার বর্ণনা

বাবা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি তার পাশেই বসা। রিয়া পেছনের সিটে বাম পাশে ছিল। পাশেই ওর মা, খালা, খালাতো ভাই-বোন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। বাম পাশে বসায় বেঁচে যাই আমরা। আমাকে গাড়ির গ্লাস ভেঙে বের করা হয়। তখন পর্যন্ত আমার স্ত্রী গাড়ির ভেতরে আটকে ছিল। চোখের সামনে সবার মৃত্যু দেখেছি। তখন পর্যন্ত বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমরা বেঁচে আছি।

স্ত্রী রিয়ার হাতের  ওপর ওর মায়ের থেতলানো মরদেহ। উত্তরায় গত সোমবার ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনার এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া রেজাউল করিম হৃদয়। দুর্ঘটনায় বেঁচে যান তার স্ত্রী রিয়া মনি। গার্ডার চাপায় প্রাণ হারিয়েছেন হৃদয়ের বাবা রুবেল মিয়া, রিয়া মনির মা ফাহিমা, তার বোন ঝরনা ও ঝরনার দুই সন্তান জান্নাত ও জাকারিয়া। শনিবার হৃদয়-রিয়ার বিয়ে হয়েছে। সোমবার ছিল বৌভাত। দাওয়াত খাওয়া শেষে দক্ষিণখানের কাওলা থেকে আশুলিয়া ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। গতকাল স্বজনদের লাশ গ্রহণ করতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান হৃদয়-রিয়া ও তাদের স্বজনরা। দুর্ঘটনায় হৃদয় এবং রিয়া কিছুটা আহত হয়েছিলেন। উত্তরার একটি হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়।  মর্গের সামনে অপেক্ষায় থাকা রিয়া বলেন, চোখের সামনে মাকে মারা যেতে দেখছি কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। আমার কোলে মারা গেছেন মা। আমার হাতের একাংশের ওপর মায়ে শরীর লেপ্টে ছিল।

কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারিনি। তখন মায়ের মুখ-নাখ আর কান দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছিল। খালাতো বোনটা ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মধ্যেই ও মারা গেছে। আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। কেন আপনারা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন? এভাবেই বিলাপের সঙ্গে প্রশ্ন ছুড়ে দেন রিয়া। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নববধূ রিয়া বলেন, বৌভাত শেষে আমার শ্বশুর তার গাড়ি দিয়ে আশুলিয়ার বাসায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন আমার শ্বশুর। তার পাশে ছিলেন আমার স্বামী হৃদয়। গাড়ির পেছনে বাম পাশে আমি। মাঝে আমার মা এবং তার পাশে আমার খালা বসেন। খালার কোলে তার মেয়ে এবং আমার মায়ের কোলে খালার ছেলে ছিল। ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গার্ডারটি উপরে ঝুলানো অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম। গার্ডারের নিচ দিয়ে গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। আমাদের গাড়ির ওপর পড়বে সেটা তো বুঝতে পারিনি। গাড়িটি গার্ডারের নিচে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি গাড়ির ওপর পড়ে। গাড়িটির অধিকাংশই গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে যায়। আমার মা, খালা, শ্বশুর আর খালাতো ভাই-বোনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। মা আমার হাতের ওপরেই ছিলেন। মা আর কথা বলতে পারেননি। আমার শ্বশুরের হাতটা শুধু দেখা যাচ্ছিল। আমার খালাতো ভাই ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই সে মারা যায়। আশপাশের লোকজন এসে গাড়ির কাচ ভেঙে হৃদয়কে বের করে। আমি পুরোপুরি গাড়িতে আটকা পড়েছিলাম। গাড়ির দরজা ভেঙে আমাকে বের করা হয়।

এরপর আমাদেরকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সারা রাত হাসপাতালেই ছিলাম।  হৃদয় বলেন, যে ক্রেন দিয়ে তারা কাজ করছিলেন সেটার ধারণ ক্ষমতা ওই কাজের জন্য উপযুক্ত না বলে জেনেছি। এত ব্যস্ত একটি রাস্তায় তারা এমন বোকার মতো কেন কাজ করবেন? তারা তো মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন! কাজ করবে ঠিক আছে, কিন্তু রাস্তাটা তো ব্লক করে দেয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, সব গাড়ি যেহেতু যাচ্ছে তাই আমরাও একইভাবে যাই। আমাদের আগের সবগুলো গাড়িও ওর নিচে দিয়ে যায়। কিন্তু আমরা যখন যেতে যাই, তখনই ওটা গাড়ির ঠিক ডান দিক বরাবর পড়ে। আর গাড়িটা মাটির সঙ্গে দেবে যায়। আমার স্ত্রীও পেছনে ছিল কিন্তু ও বাম দিকে জানালার দিকে বসায় বেঁচে যায়। আমিও বাম দিকে ছিলাম। তবে ডান দিক বরাবর পড়ায় ওরা ঘটনাস্থলেই মারা যান। গার্ডারটা এমনভাবে পড়ে যে আমার পাশে সামান্য জায়গা ছিল। ফলে আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম। কিন্তু আমার পা আটকে যাওয়ায় পায়ে ব্যথা পাই। কিন্তু রিয়ার পাশে কোনো জায়গা ছিল না।

গাড়ি আর গার্ডারের মধ্যে রিয়ার পুরো শরীর আটকে গিয়েছিল। জ্ঞান থাকলেও আতঙ্কে চিৎকার করছিল রিয়া। পরে আশপাশের মানুষ এসে আমাকে গ্লাস ভেঙে উদ্ধার করে। কিন্তু রিয়ার পরিস্থিতি এমন ছিল যে গ্লাস ভাঙা যায়নি। গাড়ির দরজা ভেঙে ওকে বের করার পর আমাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। রিয়া বলেন, আমাদের দুই ভাই-বোনকে ছোট থেকে বড় করার ব্যাপারে সম্পূর্ণটাই আমার মায়ের অবদান। সেই মাকেই এভাবে পৃথিবী থেকে আজ নির্মমভাবে চলে যেতে হলো। ওখানে আমাদের গাড়ির বদলে অন্য কোনো গাড়িও থাকতে পারতো। এরকম ব্যস্ত রাস্তায় কাজ করবে, তাহলে সিকিউরিটি নেয়া অবশ্যই উচিত ছিল, রোড বন্ধ করতো।  নিহতদের স্বজন জাহিদ বলেন, পুরোটাই প্রজেক্টের গাফিলতি। সাড়ে ৩টায় দুর্ঘটনা ঘটে। ৪ ঘণ্টা এভাবে পড়ে ছিল। আমি এসে দেখি আমার ভাগনা জীবিত, বোন জীবিত। তাদের শ্বাস চলছে। হৃদয়ের বাবা যিনি ড্রাইভ করছিলেন তার হাত কাঁপছে। প্রশাসন এবং স্থানীয়রা ছবি তোলা নিয়া ব্যস্ত।

সূত্রঃ মানবজমিন