প্রমোদতরীতে ভ্রমণ এবং নিজের অভিজ্ঞতা
সাদিয়া আফরোজ

প্রমোদতরীতে ভ্রমণ এবং নিজের অভিজ্ঞতা
ভ্রমণপিপাসু যারা ঘুরতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে প্রমোদতরীতে মহাসাগর ভ্রমণ নিশ্চয় মহা আনন্দের। কারণ, সমুদ্রের নীল জলরাশির সৌন্দর্য আপনার মনকে প্রশান্তি দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ যেন সত্যিই ভাসমান চলন্ত এক শহর। চারিদিকে উষ্ণশীতল বাতাস, নীল আর নোনাজলের উত্তাল বা শান্ত ঢেউ ভেঙে সামনের গন্তব্যে এগিয়ে চলা। রীতিমতো স্বপ্নের মতো।

বিশাল সাগরের বুক চিরে সমুদ্রবিলাসী পর্যটকদের এই সেবা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রমোদ তরী কোম্পানি। লোকেশন ভেদে নির্ধারণ থাকে ভ্রমণের প্যাকেজ। পছন্দমত নিতে পারেন ৩, ৫, ৭ বা ১২ দিনের যে কোন প্যাকেজ।

তবে সিজন ভেদে প্যাকেজের মূল্য কমবেশি হতে পারে। ‘এডভেঞ্চার অব দ্য সি’ নামের একটি প্রমোদতরীর ছয় দিনের প্যাকেজে আমরা আমেরিকার গ্যাল্ভেস্টন (টেক্সাস) বন্দর থেকে যাত্রা করে ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে মেক্সিকোর অসম্ভব সুন্দর দু’টি স্থান কোজুমেল দ্বীপ ও প্রাচীন মায়া সভ্যতার কোস্টা মায়া শহর ঘুরে এলাম।

সব নিয়মকানুন সেরে ক্রুজশিপে প্রবেশের পর মাস্ক পরার আর দরকার পড়েনি। তবে জাহাজে পা রাখার আগেই করোনা পরীক্ষা করাতে হয়েছে নিয়ম মেনে। আমরা যে প্রমোদতরীর ভ্রমণ করেছি সেটি একটি ভয়েজার-শ্রেণীর ক্রুজ জাহাজ, যা রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে।

তাদের পাঁচটি ভয়েজার-ক্লাস ক্রুজ জাহাজের মধ্যে এটি ছিল তৃতীয়। ফিনল্যান্ডে নির্মিত ক্রুজটি ২০০১ সালে ৫০ কোটি ডলারে কিনে নেয় রয়েল ক্যারিবিয়ান। এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বন্দর থেকে ক্যারিবিয়ান সাগর, বাল্টিক সাগর, ভূমধ্যসাগর, কানাডাসহ ইউরোপের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণ করে থাকে।

জাহাজটির দৈর্ঘ্যে ৩১১ মিটার বা এক হাজার ২০ ফুট ৮ ইঞ্চি। তিন হাজার ৮০৭ জন অতিথি আর এক হাজার ১৮৫ জন ক্রু। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার যাত্রী বহনে সক্ষম এটি।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমুদ্রের অ্যাডভেঞ্চার আর বিনোদন উপভোগে দারুণ সব আয়োজন রয়েছে জাহাজটিতে। এটিতে মোট ডেক ১৪টি। যাত্রীদের থাকার জন্য আছে এক হাজার ৫৫৭টি স্টেটরুম। রুমের সাথেই লাগোয়া সি-ভিউ। প্রতিটি ডেকেই আছে সমুদ্রের নীল জলরাশি ও আকাশের মিতালী উপভোগের চমৎকার ব্যবস্থা।

আর জাহাজের ভেতরে তো অন্য এক দুনিয়া। লিফটের সংখ্যাই আটটি। সিনেমা হল, অ্যাকোয়া পার্ক, তিনটি সুইমিং পুল, একাধিক লাউঞ্জ ও পানশালা, বিলাসবহুল ক্যাসিনো, হেলিপ্যাড।

যারা খেলাধুলা করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য আয়োজন দেখে চোখ চড়কগাছ। ছয়টি ঘূর্ণি, পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা পেতে প্রমোদতরীর ভেতরেই গড়ে তোলা হয়েছে পাথরের দেয়াল দিয়ে তৈরি টাওয়ার, বাস্কেটবল, ভলিবল ও গলফের আলাদা কোর্ট।

প্রযুক্তিপ্রমীদের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক গেমিং সেন্টার, আইস-স্কেটিং রিঙ, টাইফুন ও সাইক্লোন ওয়াটার স্লাইড, পারফেক্ট স্টোর্ম ওয়াটার স্লাইড, সার্ফিং এরিয়া, মিনি গলফ। আইস স্কেটিং শোগুলি শুধুমাত্র পারফর্মারদের দক্ষতার কারণেই নয়, বরং আশ্চর্যজনক ব্যাকড্রপ ও আকর্ষণীয় পোশাকের কারণেও মন্ত্রমুগ্ধ করতে বাধ্য।

পাঁচ, সাত বা ১২ দিনের ভ্রমণে নিজের ফিটনেস নিয়ে ভাববার কারণ নেই। সি স্পার মতো অত্যাধুনিক ফিটনেস সেন্টার সেরে নেয়া যাবে শরীর চর্চার কাজটি। ওয়েডিং চ্যাপেল ও লিরিক থিয়েটার একসাথে প্রায় ১৩০০ অতিথি আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

সার্কাস, স্ট্রিট-স্টাইল পারফর্মার থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ান ব্যান্ড, লাইভ মিউজিক, নাট্য পরিবেশনা, নাচ ও গানের বিশাল বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। শিশুদের জন্যও বিনোদনের কোনো ঘাটতি নেই। এন্টারটেইনিং রাইড, কারাওকে, ভিডিও গেম সহ প্রায় সব অন-বোর্ড কার্যকলাপে অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে সবার।

ভ্রমণে বেরিয়ে অনেকের খাবার নিয়ে কিছুটা চিন্তিত থাকেন। ক্রুজশিপে আবার এনিয়ে ভাববার সুযোগ নেই। নয়টি রেস্টুরেন্টের পাঁচটিই কমপ্লিমেন্টারি যেখানে আপনি দিনে বা রাতের যে সময়েই আসেন না কেন, সুস্বাদু মুখরোচক সব খাবারের আয়োজন পাবেন।

ইন্ডিয়ান, কন্টিনেন্টাল, ইটালিয়ান, চাইনিজ, থাই, জাপানিজ, ওয়েস্টার্ন কোন খাবরটি আপনার পছন্দের। পেয়ে যাবেন। আইসক্রিম পার্লারে বুদ হয়ে থাকবেন আইসক্রিম প্রেমীরা।

ক্রুজশিপগুলোতে এক বা একাধিক ফরমাল ডিনার নাইট গোটা পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। নির্দিষ্ট ড্রেসকোড আর সাজপোশাকে রাতের সৌন্দর্য আরও রঙ্গিন হয়ে ওঠে। পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে সেসব স্মৃতি করে রাখতে পারেন।

বিনোদনের ষোলকলা পূরণের পর কেনকাটা কেন বাকি থাকবে। বিশ্বখ্যাত নামী সব ব্র্যান্ডের পোশাক, ঘড়ি, হাতব্যাগ, জুতা, জুয়েলারি, সানগ্লাসের আউটলেট তো রয়েছেই, সাথে আছে স্যুভেনির এবং উপহার সামগ্রী।

২৪ ঘণ্টা মেডিকেল স্বাস্থ্য সেবা, কনফারেন্স, লাইব্রেরি এবং ইন্টারনেট সেবা কী নেই ক্রুজশিপে। আধুনিক এবং বিলাসী জীবনের সব স্বপ্নের বাস্তব এখানেই। যেন সাগরের বুকে এ এক নান্দিক সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য।

লেখক সাদিয়া আফরোজ পেশায় একজন শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরে বাস করেন। সেখানের ব্রান্ডেনবার্গ স্কুলের ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষাকতা করেন