সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। তারা মন্ত্রণালয়ের প্রধান নীতি নির্ধারক। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই গুরু দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অতীতে ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে মূল দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরাই পেয়ে থাকেন সেই ‘মন্ত্রিত্বের’ স্বাদ। অতীতে ‘সোনার হরিণ’ খ্যাত ‘মন্ত্রিত্ব’ পদটি রাজনীতিতে ত্যাগী এবং দলের প্রতি নিষ্ঠাবানদের দখলে থাকলেও বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো। কোনোদিন রাজনীতির মাঠে ছিলেন না, বিরোধী দলের হামলা-মামলায় হননি স্বীকার অথচ বর্তমানে তারাই পাচ্ছেন মন্ত্রিত্বের গুরু দায়িত্ব। অতীতে সেই সংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে বেড়েই চলছে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবীর সুনাম অর্জনের পর দফায় দফায় হচ্ছেন সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিন্তু তারা কেউ ‘ফুলটাইম’ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বর্তমান মন্ত্রিসভায় একাধিক মন্ত্রী রয়েছেন, যারা ফুলটাইম রাজনীতির সঙ্গে না থাকায় তাদের রাজনৈতিক পূর্ণতা আসেনি। রাজনৈতিক পূর্ণতা না থাকলে কোথাও না কোথাও গিয়ে আটকে যাবেই। কারণ, স্থান ও কাল বুঝে কথা বলতে পারেন না। এতে দল ও সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়।’

এদিকে একাধিক মন্ত্রীর ‘অতি বচনে’ বারবার সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগ সরকারকে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের দুটি বক্তব্যের দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেছিলেনÑ‘ভারতকে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’ এবং ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে।’ এমন বক্তব্য নিয়ে যখন দল ও সরকারের মধ্যে অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ঠিক সেই সময়ে ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ‘ঘি’ ঢেলে দিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সাধারণত যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ বাহিনীকে তাদের দিকনির্দেশনায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। তবে বরাবরই দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের এক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। পুলিশ প্রশাসন কঠোর হলে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যেত।’ তার আগে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন,‘গ্রাম-গঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেকটি মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামা-কাপড় রয়েছে।’ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে এটা সত্যি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনও কেউ মারা যায়নি।’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ‘মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে।’ তার আগে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘এ দেশের কৃষকরা এত ত্যাগী যে তারা বউয়ের গলার হার, কানের দুল বিক্রি করেও চাষাবাদ করে।’ মন্ত্রীদের এমন বক্তব্যের কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে দলটি ও সরকারকে। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের তিনজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের সঙ্গে আলাপ করলে তারা কেউ মন্ত্রীদের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রী, এমপি ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, যারা আমরা আছি, আমাদের সবাইকে কথা-বার্তার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বক্তব্য, আচরণসহ সর্বক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে।’ তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দলের কেউ নন। তার বক্তব্য দলের কোনো বক্তব্য নয়। প্রশ্ন হলো তিনি তো (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আমাদের দলের কেউ নন। সুতরাং আমাদের দল তার এই বক্তব্যে বিব্রত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে অনুরোধ করব তাকে যে তিনি যেন তার কথাবার্তায়, তার দায়িত্বশীল আচরণের ভেতর দিয়ে এমন কিছু বলবেন না, যাতে কোনো দুষ্ট লোকেরা এর সুযোগ নিতে পারে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকবেন বলে আশা রাখি।’

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘কেউ যদি বিদেশে গিয়ে কারও সঙ্গে গল্প করে আসেন, তার দায়-দায়িত্ব সরকার বা দলের নয়। উনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন। সুতরাং, তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে বিদেশে গিয়ে দায়-দায়িত্বপ্রাপ্তও কেউ নন।’

হঠাৎ করে মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা ঝড়কে আমলে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। মন্ত্রীরা কেন বক্তব্যের মাধ্যমে সমালোচনা সৃষ্টি করছেন সেই বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য। তারা বলেন, ‘আমাদের বর্তমানের মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন পেশায় এবং ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল। সেই সফলতার কারণে আমাদের নেত্রী তাদেরকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছেন। তারা মন্ত্রিসভায় আসার আগে রাজনীতিতে সফল না হলেও সমাজের অন্য কাজে থেকে উচ্চপর্যায়ের সফল।’

আওয়ামী লীগের প্রবীণ বেশ কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে এক নেতা বলেন, ‘তারা প্রতিটি মুহূর্তে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটা সময়ের জন্যও রাজনীতির বাহিরে ছিলেন না। তারাও এক সময়ে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানের অনেকেই ছাত্ররাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় থাকলেও মাঝে বিরাট একটা সময় রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তারা ব্যবসা কিংবা চাকরিতে মনোযোগী ছিলেন। সেক্ষেত্রে তারা চাকরিতে সফল ছিলেন। সেই নেতারাই চাকরির সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে এখন আবার রাজনীতিতে সক্রিয়। অনেকেই হচ্ছেন মন্ত্রী। আবার অনেকেই আগামীতেও মন্ত্রি হওয়ার সুযোগ খুঁজছেন।’

দলীয় সূত্র মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একে আব্দুল মোমেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ,  কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের রাজনৈতি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন: ২০১৮ নির্বাচনে বড় ভাই আবুল মাল আবদুল মুহিত আর নির্বাচনে না দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে তাকে সিলেট-১ আসনে তার উত্তরসূরি হিসেবে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি একাদশ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেন। নির্বাচিত হওয়ার পরে ২০২১ সালে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে রাজনীতিতে নাম লেখান।

তার আগে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শিল্প ও বাণিজ্য এবং খনিজ সম্পদ ও পেট্রোলিয়ামমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সৌদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এসআইডিএফ) এর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে রিয়াদ কম্পাউন্ড বোমাহামলার সময় তিনি সৌদি আরব ত্যাগ করে ম্যাসাচুসেটসে এ ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ফ্রেমিংহ্যাম স্টেট কলেজের অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে পড়াতেন। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি নিযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতা চালিয়ে যান। ২০১০ সালে তিনি ইউনিসেফ কার্যনির্বাহী পরিষদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৪ সালে জাতিসংঘের দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের কমিটির সভাপতি ছিলেন।

ড. আব্দুর রাজ্জাক: বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) একজন বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের প্রধান বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবন শেষ করেন। তিনি ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে জড়িত হন। ২০০১ সালে কর্মজীবন শেষ করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে রয়েছেন।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ: বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তার বাবা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ সদস্য। তার বাবা চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ওই আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার নির্বাচিত হন। তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির তিনবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ভ‚মিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মো. তাজুল ইসলাম: তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। ২৫৭নং (কুমিল্লা-৯) আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। বর্তমানে সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এমপি হওয়ার পূর্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এমপি হওয়া প্রায় দুই বছর পর উপজেলা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

শ ম রেজাউল করিম:  সাবেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ.ম রেজাউল করিম। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল আইনজীবী। তিনি পিরোজপুর-১ আসন থেকে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মানবকণ্ঠ/