বাংলা ট্রিবিউন ৯ অক্টোবর ২০২৫ , ১১:২৫:৪৩
বাংলাদেশে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। সংগঠনটির সর্বশেষ মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরও দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৬৯২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১০৭ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৫৭৯ জন আহত হয়েছেন। এ সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে—যা মোট ঘটনার প্রায় ৫৮৭টি। এসব সংঘর্ষে ৬১ জন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা-কর্মী নিহত এবং ৩ হাজার ৭৭৯ জন আহত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার মধ্যে ৭০৪টি বাড়িঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
নয় মাসে সাংবাদিকদের ওপর ২৩৬টি হামলার ঘটনায় ৩৪০ জন সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২ জন সাংবাদিককে, আহত হয়েছেন ২০৯ জন, হুমকির মুখে পড়েছেন ৫৪ জন এবং গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন সাংবাদিক।
এ সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ২৯টি মামলায় ১০৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ অনুযায়ী ১৮টি মামলায় ২৫ জনকে অভিযুক্ত ও ১৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
এইচআরএসএস বলছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২৩৯টি মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনায় ১৩০ জন নিহত ও ২১২ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চুরি বা ডাকাতির সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা, হেনস্তা ও অপমান করার প্রবণতা বেড়েছে।
এই সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৬১ জন বন্দির মৃত্যু ঘটেছে। এদের মধ্যে ১৯ জন কয়েদি ও ৪২ জন হাজতি। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ২২টি হামলার ঘটনায় ৫ জন আহত, ৫টি মন্দির ও ৩৭টি প্রতিমা ভাঙচুর এবং ৩৮টি বাড়ি-ঘরে হামলা চালানো হয়েছে। রংপুর, যশোর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দেশে ৫০টিরও বেশি মাজারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে এইচআরএসএস।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৬১টি ঘটনায় বিএসএফের গুলিতে ২৩ জন বাংলাদেশি নিহত, ৩৪ জন আহত ও ৫৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। একই সময়ে বিএসএফ বাংলাদেশে ৩ হাজার ২৬৪ জনকে পুশইন করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির হামলায় ২ জন আহত এবং স্থলমাইন বিস্ফোরণে ১২ জন আহত হয়েছেন।
এ সময় সারা দেশে ১ হাজার ৫১১ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৬৬৩ জন ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে ৩৯৩ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এছাড়া ১৫২ জন গণধর্ষণের শিকার, ১৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। একই সময়ে ১ হাজার ৬৫ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ২০৯ জন প্রাণ হারিয়েছে।
এইচআরএসএস জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে, সংঘর্ষে বা নির্যাতনে ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন বন্দুকযুদ্ধে, ৪ জন নির্যাতনে, ১০ জন হেফাজতে ও ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে ১৬৬টি মামলা দায়ের হয়েছে।
এসব মামলায় ১০ হাজার ৩৮৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩৪ হাজার ১৩৭ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এই সময়ে ৪৪ হাজার ৯৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সদস্য।
২০২৫ সালের নয় মাসে ১৭৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় ৭৪ জন নিহত ও ৮২৮ জন আহত হয়েছেন। অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে ১০৪ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এইচআরএসএস বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যা বাড়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংগঠনটি মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।