একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. ফরিদ উদ্দিন সর্বসাকুল্যে বেতন পান ২২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যয়, মুদি বাজার, যাতায়াত ভাড়া এবং ওষুধ কিনতেই মাসের মাঝপথে ৯০ শতাংশ টাকা শেষ। বাকি সময় কোনোভাবে ধারদেনা করেই চলতো সংসারের চাকা। কিন্তু এর মধ্যে ডিজেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে আরেক দফা বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। তাই দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যেরও। সীমিত আয়ের টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন এই নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। কারণ যাদের কাছ থেকে ধার নিতেন তারাও এখন আর ধার দিতে চাইবেন না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফরিদ উদ্দিনের মতো সীমিত আয়ের মানুষের এখন সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাছ-মাংসের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ আলু ভর্তা ও ডিম-ডাল খাবে, সেইসবেরও দাম বেড়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে আলু বিক্রি হতো প্রতি কেজি ২০ টাকায়। তবে গত মাসখানেক ধরে আলুর দাম কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। এ ছাড়া মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা। অন্যদিকে এক ডজন ডিমের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ টাকা। বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। নিম্নবিত্তশ্রেণীর মোটা সিদ্ধ চাল ছাড়া ৬০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোগ্যপণ্যের বাজারের ঊর্ধ্বগতি ও বছর না ঘুরতে দুই দফা পরিবহন ভাড়া বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের ও সীমিত আয়ের মানুষের সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যয় সংকোচনের জন্য শহর থেকে অনেকে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে কমেছে। তবে আমাদের দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এখন আবার নতুন করে ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পণ্য পরিবহনের খরচও আরো বেড়েছে। কোনো ব্যবসায়ী তো আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিমত, একটা নির্দিষ্ট মুনাফায় খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করেন। বর্তমানে দোকান ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। আমাদের অতি মুনাফা করার সুযোগ নেই। এ দিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার শুধুমাত্র রমজান এলেই বাজার মনিটরিং করে। মনিটরিংয়ের অভাবে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ইচ্ছে মতো বাড়ায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তারা।

ভোক্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের বাজার নিম্নমুখী শুনেছি। যে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়ে, তখন সয়াবিন তেলের ব্যবসায়ীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু যখন দাম কমে যায়, তখন সেভাবে কমে না। মাত্র দুই দফায় সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে প্রতি লিটার ১৮৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এর আগে সয়াবিনের দাম সর্বোচ্চ ২০৫ টাকা পর্যন্ত উঠে। প্রথম বার ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা, পরের বার ১৪ টাকা কমিয়ে ১৮৫ টাকা করা হয়। অথচ সে সময় আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী দাম আরো কমার কথা। এখন আবার ব্যবসায়ীরা নতুন করে প্রতি লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। শুধু সয়াবিন নয়, বেড়েছে চিনির দামও। গতকাল নগরীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে চিনির দামও। চিনির দাম কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮২ টাকায়। এ ছাড়া মসুর ডালের দাম কেজিতে ২৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা, পেঁয়াজের কেজি ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা, আদা কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা এবং রসুন ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। অপরদিকে পোল্ট্রি খাতের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মুরগির দামও। গতকাল খুচরা দোকানে মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকায়।

বেসরকারি চাকরিজীবী ইমাম উদ্দিন বলেন, ২০২০ সালে দেশে করোনা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এক টাকাও বেতন বাড়েনি। কিন্তু প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে খরচ বাড়ছে। সরকার ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ, ওষুধ খরচ ও বাসা ভাড়া দিতেই বেতনের বেশিরভাগ খরচ হয়ে যায়। আলী হোসেন নামের একজন দিনমজুর বলেন, ব্যয়ের তুলনায় আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বিপদে আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালানোটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যে দাম বাড়েনি। তেল-ডাল ও চিনির দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া থেমে থেমে চালের দামও শুধু বাড়ে।