শিক্ষা ও দাম্ভিকতা

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল

শিক্ষণ জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এ ধরায় মানব জাতি নানা বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্বের কূপমণ্ডূকতা এবং কালো রেখার মূলোৎপাটন করে সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চাসনে আরোহণের মাধ্যমে যেমন করে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে স্বীয় মেধা ও মননের জানান দেয়, পাশাপাশি অহমিকা, দৃষ্টিভঙ্গির দীনতা, ভোগবাদী মানসিকতা, চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকে স্বীয় ব্যক্তিত্বের পরিচয় সমাজভুবনে উপস্থাপনের মাঝেই দ্বৈত অস্তিত্ব তুলে ধরে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি মানুষের মণিকোঠায় আদর্শ ও অনুকরণের প্রতিচ্ছবি হওয়ার কথা, অথচ আমাদের চারপাশে বাস্তবে আমরা কী দেখছি? শিক্ষিত ব্যক্তির এরূপ আস্ফালন তো দেখার বিষয় ছিল না। একবিংশ শতকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিপূর্ণতার যুগে এসব কী ঘটছে? যেখানটায় একজন শিক্ষিত ব্যক্তি বিনয়ী ও অনুকরণীয় হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কী দেখছি? উচ্চশিক্ষা সমাপনীতে ব্যক্তি বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে আত্মম্ভরিতার পরিপূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ দ্বারা প্রভাবিত প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষিত হওয়ার মাঝে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের যেসব গুণাবলি বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, তা যেন আজ যোজন যোজন দূরে। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত মানুষজন অমায়িক, বন্ধুবৎসল, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণকারী, সৎ, কর্মঠ, যৌক্তিক-পরোপকারী গুণে প্রজ্বলিত হওয়ার কথা, বাস্তবে কী দেখছি? এর পশ্চাতে সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের দীনতা, দৃষ্টিভঙ্গির বিভাজন, অনাচার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ- এ প্রপঞ্চগুলো কি অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে?

ইদানীং দেখা যায় শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিদ্বান নিজেদের সবার চাইতে বড় বা শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং এমন মনে করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এসব ব্যক্তি প্রায়শই হীনম্মন্যতা এবং ব্যক্তিত্বহীনতার সংকটে ভোগে। আমাদের দেশে পেশার ধরন ও কর্মপরিধির বিচারে পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যবোধ রয়েছে। সব পেশার সুযোগ-সুবিধা বাহ্যিক সম্মান ও ক্ষমতা সমসাময়িক মানদণ্ডের বিচারে এক নয়। শিক্ষকের কর্মপরিবেশ ও নীতিমালা অনুযায়ী গাড়ি-বাড়ি পাবেন না, দৃশ্যমান চাকচিক্যের সুযোগ থাকবে না। তার পরও যদি কোনো শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এরূপ আশা করেন, তখন বিপত্তিটা সেখানেই তৈরি হয়। এত লোভ কেন?

মেধাবীরা এদেশের কর্মবাজারে একটি বড় অংশ দখল করে রাজত্ব করবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এখানেই সত্যিকারের স্বকীয়তা ও শোভাবর্ধন হয়। অথচ আমাদের দেশে অনেক কর্মকর্তাকে দেখা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের নিমিত্তে আওতা-বহির্ভূত অনেক বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে সমাজ তথা চারপাশে শক্তিশালী নেটওয়ার্কের জানান দেয়। শিক্ষার্থী হিসেবে তার বিশ্বাস মতের ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কর্মবাজারে অন্তর্ভুক্তি ঘটে তখন তার স্বতন্ত্র পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীতে পরিণত হয়। ইচ্ছা করলেই রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতায় রাজনৈতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করার সুযোগ থাকে না। অথচ আমরা কী লক্ষ্য করছি? প্রায়শই দেখা যায় সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সাবেকী সম্পর্কের জানান দিয়ে নিজেদের ক্ষমতাধর ভেবে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা জনের সঙ্গে সম্পর্কের ছবি ওয়ালে আপলোড করার হীন বাতিক আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে একবারও কি ভেবেছেন? এরূপ অসংগতি কি অহমকে উৎসাহিত করছে না?

গত শতকের এক জাঁদরেল আমলার স্মৃতিচারণমূলক জবানিতে শিক্ষিত মানুষজনের হীনম্মন্যতা, সংকীর্ণতা, নিজেকে অযাচিত জাহির করার প্রবণতা এবং তৎকালীন মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং লজ্জাশীলতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একদা সেই আমলার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন মফস্বলের এক ব্যবসায়ী। যিনি কিনা তার দূরসম্পর্কের স্বজনও বটে। সেই ব্যক্তির পীড়াপীড়িতে অগত্যা উচ্চপদস্থ ওই সরকারি ব্যক্তি ব্যবসায়ীর সঙ্গে তারই ড্রইংরুমে ফটো তুলতে রাজি হন। খায়েশ বলে কথা- নিরাশ তো করা যায় না। কয়েকদিন পর দেখা গেল সেই ছবিসহ সাক্ষাতের বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন হয়েছে। যেখানটায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমোদন ছিল না। পরবর্তী সময়ে সামাজিক মূল্যবোধ, লজ্জাশীলতা এবং তৎকালীন বাস্তবতায় দুঃখ প্রকাশ করে দায়মুক্তির আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ আজ আমরা কী অবলোকন করছি?

বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার এবং নানা পদের সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপের সহজলভ্যতার সুযোগে বড়কর্তার ছবি পুঁজি করে নিজের ক্ষমতা, অস্তিত্ব, চাটুকারিতা, সামাজিক পরিমণ্ডলে অন্যের চেয়ে বড় এবং হাত অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত- এ বিষয়গুলো জানান দিতে চায়। এই মানসিকতার প্রভাবের কারণেই শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এ প্রতিযোগিতা থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এ যেন সোনার হরিণ! কার আগে কে ধরতে পারে। যে কারণে দেখা যায়- অপরাধীরা যখন ধরা পড়ে এবং তাদের অতীত আমলনামা যখনই উন্মোচিত হয়, তখন দেখা যায় সমাজের অনেক উঁচু মানুষের সান্নিধ্যের ফটো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা ছিল। স্বাস্থ্যে শাহেদ-সাবরিনা, ব্যবসায় ডেসটিনি, শিক্ষায় নানা ধরনের মানুষজনের অস্তিত্ব সমাজের মূল্যবোধহীনতার পরিচয়ই বহন করে।

শিক্ষাঙ্গন সংশ্লিষ্ট মানুষজন এ যাবৎকালে প্রচারবিমুখ ছিল। এসব বিষয়ে তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। যেহেতু সে সমাজেরই অংশ, তাহলে সুযোগ হাতছাড়া করাটা কেমন হয়ে যায় না? যে কারণে এসব পণ্ডিত ব্যক্তিরা ও ইদানীং বড়কর্তার সঙ্গে কোনো সুযোগে সাক্ষাৎ করতে পারলেই একখান ছবির আবদার করে বসেন। যা পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ সময়ই অনুমতির তোয়াক্কা না করে স্বনিয়ন্ত্রিত ওয়ালে আপলোড করে নিজের অস্তিত্ব অহংবোধ চাটুকারিতার নির্লজ্জ প্রদর্শনীর সমাবেশ ঘটিয়ে নিজের অজান্তেই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট জনসমষ্টির স্বকীয়তা, মনন, আপসহীন মনোভাব ব্যক্তিত্বের রুচিশীলতার মণিকোঠায় দাগ লেপন করে। এসব পরজীবী স্বার্থপর শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ভার পুরো জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। এ ব্যক্তিরা যেমনভাবে ধিক্কারের শিকার হচ্ছে, ছাত্রছাত্রী সহকর্মী এবং জনগোষ্ঠী দ্বারা পাশাপাশি তাদের লোভ এবং সাময়িক ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারা ও নানাভাবে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। একজন বিদ্বানের কাছ থেকে জাতি এ আশা করেনি। তাহলে গলদ কোথায়? অপকর্মের স্রোতে কেন গা ভাসিয়ে দিচ্ছে?

শিক্ষিত দাম্ভিক ব্যক্তিরা ভালো পরামর্শ গ্রহণ করতে চায় না। নিয়ত লাভের পেছনে দৌড়ানোকেই সবসময় নিয়ামক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। অবশ্য এসব মানুষ তাদের সহযোগী হিসেবে একদল জ্ঞানপাপীকেও পেয়ে যায়, যারা কিনা শ্রেণিকক্ষবিমুখ মোনাফেক এবং দ্বিচারিতাই যাদের চরিত্রের প্রধান অলংকার। অল্প সময়ে এসব বর্ণচোরাকে চেনা যায় না। যারা কখনও ক্ষতি মেনে নিতে পারে না। ছলে-বলে-কৌশলে সব সময় ক্ষমতার পাশাপাশি থাকতে পছন্দ করে।

এ থেকে কি আমরা পরিত্রাণ পাব না? এ যেন কোটি টাকার প্রশ্ন। সমাজে শিক্ষিত মানুষজন যখন জ্ঞান-গরিমা, মনমানসিকতা, ব্যক্তিত্বে, পাণ্ডিত্যে আলো ছড়িয়ে লোভ-লালসা, অহংবোধ, অসততা, ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম ও পাপাচারকে না বলে সামনে এগোনোর শপথ নেবে, সেদিনই আমরা সুন্দর সময়ের দেখা পাব।

লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Email: alioakkas@gmail.com