আজকের পত্রিকা ১০ অক্টোবর ২০২৫ , ৮:১৯:৪১
তথ্যই শক্তি—এই প্রবাদ বর্তমান বিশ্বে ভয়ংকরভাবে সত্য হয়ে হাজির হয়েছে। এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তথ্যমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মাত্র কয়েক ব্যক্তির হাতে, যাঁরা বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি ধনকুবেরদের তালিকায় রয়েছেন।
চার শীর্ষ ধনী এখন এমন সব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রধান বিনিয়োগকারী, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মতামত ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের জগৎ ছাড়িয়ে গণমাধ্যমের ওপর এই নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ জনমনে গণতন্ত্র, তথ্যের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ারস ইনডেক্স এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ইলন মাস্ক (টেসলা, স্পেসএক্স), ল্যারি এলিসন (ওরাকল), মার্ক জাকারবার্গ (মেটা) ও জেফ বেজোস (অ্যামাজন)। অবশ্য এই তালিকায়, বিশেষ করে প্রথম দুটি স্থানে, প্রায়ই পরিবর্তন দেখা যায়।
তবে, বার্ষিক তালিকার দিকে তাকালে একটি নির্দিষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ চার ধনী ব্যক্তি ও তাদের আনুমানিক সম্পদ ছিল নিম্নরূপ—
১. ইলন মাস্ক: ৩৪২ বিলিয়ন ডলার
২. মার্ক জাকারবার্গ: ২১৬ বিলিয়ন ডলার
৩. জেফ বেজোস: ২১৫ বিলিয়ন ডলার
৪. ল্যারি এলিসন: ১৯২ বিলিয়ন ডলার
এই চার শীর্ষ ধনী ব্যক্তিই এখন শীর্ষস্থানীয় চারটি গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক। নিচে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
অ্যামাজন ও ব্লু অরিজিনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ২০১৩ সালে ২৫০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’। বেজোসের বিপুল অর্থ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান পত্রিকাটিকে ডিজিটাল যুগে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করলেও এর সম্পাদকীয়র স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সমালোচকদের মতে, বেজোসের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সংবাদ ওয়াশিংটন পোস্ট কতটা নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক ২০২২ সালে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার, যার নতুন নাম এখন ‘এক্স’। মাস্কের দাবি, তিনি ‘বাক্স্বাধীনতা’ রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্ম কিনেছেন। কিন্তু বাস্তবে, এক্সের অ্যালগরিদম এখন সরাসরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কোন খবর বা মতামত বেশি প্রচার পাবে এবং কোনটি মুছে দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন মাস্কের হাতে। তাঁর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক এজেন্ডা যে এই প্ল্যাটফর্মের তথ্যপ্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন।
মার্ক জাকারবার্গ সরাসরি কোনো সংবাদমাধ্যম কেনেননি, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেটা প্ল্যাটফর্মস (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ) এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম। কোন সংবাদমাধ্যম আর্থিকভাবে লাভবান হবে বা কোন খবর ব্যবহারকারীরা বেশি দেখবেন, তা নির্ভর করে জাকারবার্গের সংস্থার নির্ধারিত অ্যালগরিদমের ওপর। এর ফলে বিশ্বের তথ্যপ্রবাহের ওপর তার যে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি মালিকানার চেয়েও শক্তিশালী।
ওরাকলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন সরাসরি কোনো সংবাদমাধ্যম কেনেননি, কিন্তু তিনি ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন। ইলন মাস্ক যখন টুইটার (বর্তমান এক্স) কেনেন, তখন এলিসন ছিলেন অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী, তিনি ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। এই বিপুল আর্থিক সহায়তা মাস্ককে প্ল্যাটফর্মটি অধিগ্রহণ করতে সাহায্য করে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরাসরি মালিক না হয়েও এলিসন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনিয়োগের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তথ্যের প্রবাহকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর এই ভূমিকা দেখিয়ে দেয়, গণমাধ্যমের ওপর ধনকুবেরদের প্রভাব কেবল সরাসরি মালিকানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনা বাইটড্যান্সের চুক্তির ফলে ল্যারি এলিসন সরাসরি টিকটকের মালিক না হলেও তাঁর কোম্পানি ওরাকলের মাধ্যমে তিনি এই প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাইটড্যান্সকে টিকটকের মার্কিন কার্যক্রম বিক্রি বা আলাদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ওরাকল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, যেমন—
প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব: ওরাকল টিকটকের মার্কিন ব্যবহারকারীদের সমস্ত ডেটা তাদের ক্লাউড পরিকাঠামোতে সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে।
অ্যালগরিদম মনিটরিং: চুক্তির অধীনে ওরাকল টিকটকের মূল রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদমটি তদারকি করবে। এর উদ্দেশ্য হলো প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট প্রবাহ যেন কোনো বিদেশি স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত বা ম্যানিপুলেট না হয়, তা নিশ্চিত করা।
প্রধান বিনিয়োগকারী: ল্যারি এলিসন একটি মার্কিন কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা টিকটকের নতুন মার্কিন ইউনিটের একটি বড় অংশ (প্রায় ৮০ শতাংশ) অধিগ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। সুতরাং, ল্যারি এলিসন তাঁর প্রযুক্তি সংস্থা ওরাকলকে কাজে লাগিয়ে টিকটকের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখছেন।
মিডিয়া বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যখন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিজেরাই সেই সব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রধান বিনিয়োগকারী হয়ে যান, যাঁদের কাজ হলো ক্ষমতার অপব্যবহার জনগণের সামনে উন্মুক্ত করা, তখন একটি সুস্পষ্ট ‘স্বার্থের সংঘাত’ তৈরি হয়। এটি গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে এবং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে দুর্বল করে দেয়।
সাধারণ মানুষ ও সরকারগুলোর জন্য এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। কারণ তথ্যের প্রবাহ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত ও ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।