রিটার্ন দাখিলের নতুন শর্তে বিপাকে ব্যাংক ও গ্রাহক
|আহমেদ তোফায়েল|

আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করায় এবার প্রভাব পড়ছে ক্ষুদ্র ঋণ, ক্রেডিট কার্ডসহ সঞ্চয়পত্রে। এবারের বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা গ্রহণে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতদিন শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) জমা দিলেই অনেক সেবা মিলত। কিন্তু এবার অনেক ক্ষেত্রে দিতে হবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র।

যেসব সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণের জন্য আবেদন, ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হওয়া উল্লেখযোগ্য। ব্যাংকগুলোতে অনেক ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা ঋণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। একইভাবে ক্রেডিট কার্ড ও সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকরাও আয়কর রিটার্ন না থাকলে সেবা নিতে পারছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে।

ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার বেশি হলেই এখন গ্রাহককে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হচ্ছে। না হলে ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না। কারণ, রিটার্ন ছাড়া ঋণ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এবারের বাজেটের অর্থবিলে এই ধরনের জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। এদিকে যারা আগে ব্যাংক থেকে এসব সেবা নিয়েছেন তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্যও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের মোবাইলফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে। ফলে যারা বিভিন্ন কারণে টিআইএন গ্রহণ করেছেন, কিন্তু রিটার্ন দিচ্ছেন না, এখন তাদেরও রিটার্ন দিতে হবে।

জানতে চাইলে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেডের হেড অব কার্ডস মোহাম্মদ শফিউল আজম ইত্তেফাককে বলেন, ক্রেডিট কার্ড দিতে রিটার্নধারী লোকই পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে টিআইএন আছে প্রায় ৬০ লাখ লোকের। এর মধ্যে রিটার্ন জমা দেন ২২ লাখ লোকের মতো। এতদিন টিআইএন থাকলেই ক্রেডিট কার্ড দেওয়া যেত। এখন যাচ্ছে না। অর্থাৎ এ কারণে ক্রেডিট কার্ডের বাজার ছোট হয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে না দেওয়ার কোনো নির্দেশনা তাদের হাতে নেই। তিনি বলেন, বাজেটে ক্রেডিট কার্ডে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার কারণে এ খাতে তাদের ক্রেডিট কার্ড বিক্রি ও ব্যবসা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকও। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট ঋণ ও কম আয়ের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্ন উপায়ে কর আহরণের লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানতেও বড় ধাক্কা লাগতে পারে। এতে ব্যাংকের ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসতে পারে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলেন, প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেকের করযোগ্য আয় আছে কিন্তু কর দিচ্ছে না। এই উদ্যোগের ফলে অনেকেই বাধ্যতামূলক ভাবে করের আওতায় চলে আসবেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে ছোট অঙ্কের ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। যারা ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করেন, তারা ছোট ঋণ ও কার্ড নিতে পারতেন। এসব সেবা নিতে তারা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেন, তবে রিটার্ন দেন না। এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ছোট ছোট ব্যবসা খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা যদি ঋণ থেকে বঞ্চিত হয় তবে কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। ব্যাংক ঋণ দেবে—এটি ব্যাংকের কাজ। আর আয়কর দিচ্ছে কি না, এটি এনবিআরের কাজ। একটির সঙ্গে আরেকটি লিংকআপ করা অযৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি। এদিকে বাজেটে ব্যাংকগুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক যে আমানত আছে, তার সুদের ওপর উৎস কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে গ্রাহকরা বেশ চাপে আছেন বলে জানান ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের জুনে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। গত জুনে এ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায়। বাজেটের পরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের পরিসংখ্যান এখনো আসেনি। জুলাইয়ের পর থেকে এর ব্যবহার কমে গেছে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এদিকে টিআইএন দিয়ে এর আগে সঞ্চয়পত্র কেনা গেলেও এবার রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখাতে হবে। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।