জাতীয়

জুলাইয়ের দায়দেনা

  প্রথম আলো ৫ আগস্ট ২০২৫ , ৩:৪৩:৫৭

জুলাইয়ের দায়দেনা

আরও বড় পরিবর্তন সম্ভব

“আনু মুহাম্মদ”

গত বছরের ২ আগস্ট অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণে দ্রোহযাত্রা হয়। সেখানে আমি বলেছিলাম, ‘কেবল হাসিনার পতন বাংলাদেশের মুক্তি আনবে না। পুনঃ পুনঃ স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বেড়ে ওঠা বন্ধ করবে না।…মুক্তিযুদ্ধকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।…মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের হাতে ফেরত নিয়ে আসতে হবে।…লুটপাট, অন্যায়, দুর্নীতি, প্রাণপ্রকৃতিবিধ্বংসী ‘উন্নয়নের’ নামে স্বৈরতন্ত্র দিয়ে জনগণের ওপর আক্রমণ আর চলবে না।…হাসিনা সরকারের পদত্যাগ অবশ্যম্ভাবী, তারপর বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে হবে, সেই আলোচনাই হবে এখনকার প্রধান আলোচ্য বিষয়।…শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, শ্রমিক সংগঠন, নারী সংগঠন—সবার সম্মিলিতভাবে এই রূপান্তরের পথে কাজ করতে হবে, অবদান রাখতে হবে।’ (২ আগস্ট ২০২৪)

এক বছরের মাথায় মনে হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এই গতিমুখ তৈরিতেই আমাদের দুর্বলতা প্রকট। সে জন্য উল্টো বাড়ছে বৈষম্যবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দাপট, হুংকার।

গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য ও বৈশিষ্ট্য

তবে এ কারণে শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার অসাধারণ অভ্যুত্থানের গুরুত্ব খর্ব করে দেখা যাবে না। এর সাফল্যকে ধরেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সাফল্য প্রধানত তিনটি: এক. আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, অত্যাচারী, জোর করে ক্ষমতায় বসে থাকা প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়েছে। দুই. এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিদিনের নির্যাতন, হুমকি এবং রাষ্ট্রীয় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে। যদিও আবারও এগুলোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তিন. বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আলোচনা, বিতর্কের উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। সবারই যেন কিছু বলার আছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আছে, মত-ভিন্নমত আছে। বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি হওয়া, এর জন্য সরব হওয়া একটি বড় সাফল্য। এর মধ্যে এখন যে নানা পিছুটান, সংশয় ও ভয় তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করা আমাদের দায়িত্ব।

সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্যগুলোও খেয়াল রাখতে হবে: প্রথমত, আগের মতোই তরুণেরা এই আন্দোলনেরও শীর্ষ ভূমিকায় থেকেছেন। এতে বাম-ডান বিভিন্ন দল, শিক্ষার্থী-নারী-পেশাজীবী সংগঠনসহ অসংখ্য মানুষের ভূমিকা থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল না। দ্বিতীয়ত, এবারের আন্দোলনে সক্রিয় সংবেদনশীল ভূমিকা ছিল নারী, শ্রমজীবী মানুষ, লিঙ্গীয়-ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষসহ দলীয় পরিচয়ের বাইরে সমাজের বিভিন্ন অংশের। তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডিজিটাল প্রযুক্তির, যার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত খবর গেছে, নৃশংসতা ও প্রতিরোধের ভিডিও চিত্র মানুষকে জমায়েত করেছে, আন্দোলনকারীরা পরস্পর সংযুক্ত থেকেছে। চতুর্থত, এবারের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের স্পষ্ট অবস্থান না থাকায় অসংখ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পঞ্চমত, দেয়ালে দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা আঁকায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে বহু গান, তথ্যচিত্র, লেখা, কার্টুনসহ সৃজনশীল কাজ। সেখানে সব ধর্ম, জাতি, শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য দূর করে সমতার বাংলাদেশের স্বপ্ন উঠে এসেছে।

বৈষম্যের বিভিন্ন মুখ

এই স্বপ্নপূরণের জন্য বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো নির্দিষ্ট করা দরকার। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৃষ্টিগ্রাহ্য বিকাশ ঘটেছে, আকার বেড়েছে অনেক, অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে, জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু একই সময়ে শ্রেণিবৈষম্য বেড়েছে প্রকটভাবে। স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিশ্রমের দেশ চলে গেছে মুষ্টিমেয়র হাতে, শ্রেণি-আধিপত্য প্রবল হয়েছে। জিডিপিতে নিচের ৯০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমে শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যার সিংহভাগ আরও শীর্ষ ১ শতাংশের দখলে। এদের কারণে দেশের বিপুল সম্পদ লুণ্ঠিত ও পাচার হয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে, বারবার স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে আটকে গেছে দেশ। দেশের নদী-বন-পাহাড়-বাতাস তথা প্রাণপ্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা, জুলুম অব্যাহত আছে। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান শ্রেণিবৈষম্যের অন্যতম চিহ্ন। এগুলোর ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের প্রকৃত আয় কমিয়েছে। চিকিৎসা বা সন্তানদের শিক্ষিত করাতে গিয়ে তাদের অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ঘরে-বাইরে আইনে-অনুশাসনে লিঙ্গীয় বৈষম্য। সম্পত্তি-সন্তানের অধিকার, খেলাধুলা-কর্মসংস্থান এবং চলাফেরার মতো ক্ষেত্রগুলোতে নানা রকম বাধা এখনো প্রবল। নারীর নিরাপদ জীবন, চলাফেরা, শিক্ষা ও কাজের অধিকার, সম্মান, স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা বিবিধ প্রতিকূলতার শিকার। লিঙ্গীয় বৈচিত্র্য হুমকির মুখে।

তৃতীয়ত, জাতিগত-ভাষাগত বৈষম্য। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতিসত্তা ও ভাষাভাষীর অস্তিত্ব সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়। উপরন্তু তাদের জমি, ভাষা, সংস্কৃতি—সবকিছুই দখলদারদের থাবার মুখে। এর ওপর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতা। গণ-অভ্যুত্থানের পরও তাদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে।

চতুর্থত, ধর্মীয় বৈষম্য। শুধু সংখ্যাগুরু থেকে ভিন্ন ধর্মের মানুষই বৈষম্যের শিকার নয়, একই ধর্মের মধ্যেও সংখ্যালঘু/দুর্বল গোষ্ঠী বৈষম্য-নিপীড়নের শিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভেতরে ও বাইরে দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটানো বৈষম্যবাদী ব্যবস্থার ফলাফল। গুজব তুলে তাদের ওপর মব-সন্ত্রাস প্রায় নিয়মিত ঘটনা।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা

গত এক বছরে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন এবং প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা এই সরকারের একটি বড় সাফল্য। তবে এসব প্রতিবেদনে আশু সংস্কার কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারে এ রকম সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর দিকে মনোযোগ না দেওয়া হচ্ছে সরকারের বড় ব্যর্থতা। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব। কিন্তু লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ অসংখ্য ব্যক্তির নামে পাইকারি মামলা, শত–হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মানুষকে হয়রানি করা, মামলা দেওয়ার বা আটকের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির কারণে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জরুরি কাজ হালকা ও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এই বছর নাটক, বাউলগান, মেলা, মাজার, ধর্মের মধ্যে ভিন্ন ধারার মসজিদ, মন্দির, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—এগুলোর ওপর হামলা হয়েছে একের পর এক। নারীবিদ্বেষী অপমানজনক বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে, সরাসরি হামলা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।

স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ। জিডিপিতে নিচের ৯০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমে শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যার সিংহভাগ আরও শীর্ষ ১ শতাংশের দখলে।

গত এক বছরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন বঞ্চিত জনগোষ্ঠী যখন ন্যায্য দাবিদাওয়া উপস্থাপন করেছে, তখন তাদের ওপর শক্ত দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। কিন্তু ‘মব ভায়োলেন্স’ যারা করে, তাদের প্রতি দেখা গেছে সরকারের নমনীয়তা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরজবরদস্তি করে কাউকে বসানো, কাউকে নামানো, নারী শিক্ষক, লেখক ও পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে হিংসা–বিদ্বেষ ছড়ানো এবং মব ভায়োলেন্স দেখা গেছে একের পর এক।

কারখানা খোলা কিংবা বকেয়া মজুরির দাবি নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে হয়েছে বারবার। তাঁদের ওপর গুলি হয়েছে। কাজের দাবিতে বহু সভা-সমাবেশ হলেও মনোযোগ পায়নি। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে ধরপাকড় হয়েছে। শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষায় সরকার ১৮ দফা চুক্তি করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। বিভিন্ন কারখানা বন্ধ করায় বেকার বেড়েছে লক্ষাধিক। দারিদ্র্য বেড়েছে।

হাসিনা মডেলের পেছনের শক্তি

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি–লুটপাটের অনেক তথ্য এখন সুলভ। যে নীতিমালার কারণে এই লুণ্ঠন এবং সম্পদ পাচারের মডেলটা দাঁড়িয়েছিল, তার প্রধান কারিগর হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও জাইকা গোষ্ঠী। যারা একদিকে বহুজাতিক পুঁজির প্রতিনিধি, অন্যদিকে দেশের লুটেরা গোষ্ঠীর মুরব্বি কিংবা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। বড় সমস্যা হচ্ছে, ফলাফল ভয়াবহ হলেও তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাণিজ্যিকীকরণ, বিপুল সম্ভাবনাময় পাটশিল্পের বিপর্যয়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের চোরাবালি সংকট, রেলওয়ের গতিহীনতা, পানিসম্পদের অব্যবস্থা, নদীর দূষণ–দখল, বন বিনাশ—প্রতিটির পেছনে এদের বিভিন্ন প্রকল্প আছে। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরামর্শক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, আমলাতন্ত্র থাকে; থাকে বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যারা এসবের সুবিধাভোগী। এটা হলো সম্মিলিত জোট, বিশ্বজোট। দেশে অতিধনী লুটেরা গোষ্ঠী তৈরির এই মডেল তাই বরাবর এদের সমর্থন ও প্রশংসা পেয়েছে।

যে বিষয়গুলোতে মনোযোগ ও সক্রিয়তা জরুরি তার মধ্যে অন্যতম হলো: অসহিষ্ণুতা, মব-সন্ত্রাস, পাইকারি মামলা, হয়রানি, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সামাজিক মতাদর্শিক প্রতিরোধ তৈরি করা, যাতে সরকারের ভূমিকারও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।

এখতিয়ার না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের মতোই বিদেশি কোম্পানিনির্ভর, ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর নানা চুক্তি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি থেকে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে পেট্রোবাংলাকে না জানিয়ে। মার্কিন কোম্পানি থেকে ২৫টি বোয়িং কেনার চুক্তির কথা বলা হয়েছে কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই। ট্রাম্পের আদেশ মানতে সে দেশ থেকে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি, তাদের দাবি অনুযায়ী সব বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনগণের কাছে এসবই গোপন রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য কোনো টেন্ডার ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তির হাসিনা-প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখাচ্ছে সরকার। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি কোম্পানির লবিস্টদের কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। চট্টগ্রাম বন্দরের সব ট্যারিফ ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে বিদেশি কোম্পানি এসে খুব সহজে বড় মুনাফা পেতে পারে। মনে হচ্ছে সরকারের অগ্রাধিকার জনগণ নয়, বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থ।

জনস্বার্থে অগ্রসর হতে কী কী কাজে গুরুত্ব দিতে হবে

এই পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক ও সরকারের দিক থেকে যে বিষয়গুলোতে মনোযোগ ও সক্রিয়তা জরুরি, সেগুলো হলো:

অসহিষ্ণুতা, মব-সন্ত্রাস, পাইকারি মামলা, হয়রানি, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সামাজিক মতাদর্শিক প্রতিরোধ তৈরি করা, যাতে সরকারের ভূমিকারও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।

বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাস সব সময় সামনে রাখা। তেভাগা, টঙ্ক, হাজংসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬০-এর দশকে সামরিক শাসনবিরোধী লড়াই ও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতার পর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসনবিরোধী লড়াই ও ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান, দেড় দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী লড়াই এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান—সবই উজ্জ্বলভাবে জাতীয় স্মরণে রাখতে হবে। সবার ওপর রাখতে হবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার বাঙালি দোসর আলবদর-রাজাকারদের ভয়ংকর গণহত্যা ও জুলুমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও শ্রেণির মানুষের অসম্ভব সাহসী প্রতিরোধযুদ্ধের স্মৃতি ও অঙ্গীকার।

গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানেরও বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই স্বপ্নকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না।

প্রাণ, প্রকৃতি, নদী, বন-জঙ্গল, উন্মুক্ত স্থান-বিনাশী কোনো প্রকল্প উন্নয়ন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা নিশ্চিত করা। রামপাল, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী, রূপপুরসহ এ রকম প্রকল্প বাতিলের পথ তৈরি করা। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল ‘নয়া উদারতাবাদী’ অর্থনৈতিক মডেল থেকে বের হয়ে সর্বজন ও সর্বপ্রাণমুখী মডেল দাঁড় করানো। জনসম্মতি ছাড়া গোপনে দীর্ঘমেয়াদি কোনো চুক্তি থেকে বিরত থাকা। অতীতের সব চুক্তি প্রকাশ।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা, স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার প্রদান।

নারীর চলাফেরা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা বাধামুক্ত ও নিরাপদ করতে সমাজে জোর জনমত তৈরি করা।

সারা দেশে গান, নাটক, মেলা, আলোচনা, পাঠাগার, চলচ্চিত্রসহ সাংস্কৃতিক তৎপরতা সব বাধা ও হুমকি থেকে মুক্ত করে তার বিস্তারের পথ নিশ্চিত করা।

প্রতিহিংসা, বলপ্রয়োগের অপসংস্কৃতি পরাজিত করে মতের বদলে মত, লেখার বদলে লেখার সংস্কৃতি জোরদার করা।

জাতীয় সংসদসহ সব পর্যায়ে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

ধর্ম, জাতি, লিঙ্গপরিচয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার পথ তৈরি করা। সমাজে বৈচিত্র্যকে উদ্​যাপন করা, রক্ষা করা; বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অবস্থান গ্রহণ।

রাজনৈতিক দলের সংস্কারের প্রশ্নও এখানে প্রাসঙ্গিক। কয়েকটা পরিবর্তন খুব গুরুত্বপূর্ণ—প্রথমত, রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবসরের বয়স ঠিক করা, যাতে চিরদিন নেতা থাকার সংস্কৃতির অবসান ঘটে এবং নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সব পর্যায়ের কমিটি প্রকাশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা। আনুগত্য এবং লেনদেনের মধ্য দিয়ে কমিটি গঠনের অগণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করা। তৃতীয়ত, জাতীয় রাজনৈতিক দলে সমাজের সব বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। মানে নারী, পুরুষ, অন্য লিঙ্গ, অন্যান্য ধর্ম, বিভিন্ন বিশ্বাস, তাদের সবার প্রতিনিধিত্ব নিয়েই কোনো দল নিজেকে জাতীয় রাজনৈতিক দল বলতে পারবে।

স্বপ্ন দেখা ও তা বাস্তবায়নের সাহস চাই

গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানেরও বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই স্বপ্নকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। অতীতের মতো শুধু নেতানেত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নীরব সৈনিকের ভূমিকা পালনের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে নাগরিকেরা নিজেরা স্বপ্ন দেখা ও তা বাস্তবায়নের সাহস করতে পারলেই যথাযথ পরিবর্তনের পথ তৈরি হবে। তার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃত করতে হবে। পরিবর্তন যে সম্ভব, গত গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে তার একটা প্রমাণ। তার ওপর ভর করে আরও বড় পরিবর্তনও সম্ভব।

গত বছরে দ্রোহযাত্রার সময়ে বলেছিলাম, এখনো বলতে চাই, আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে—আমাদের ইতিহাস শুধু মার খাওয়ার ইতিহাস নয়, আমাদের ইতিহাস প্রতিরোধেরও ইতিহাস, নতুন নির্মাণের ইতিহাস।

* আনু মুহাম্মদ: লেখক; সম্পাদক, সর্বজনকথা

আরও খবর

১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ মাত্র ৮ মাসে

ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন

আমাদের তরুণ প্রজন্ম নতুন পৃথিবী সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে চায়: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১০ বছর ধরে আটকে আছে পানি ও নদীর প্রকল্প

মার্চের মধ্যে দলের মতামত চায় ঐকমত্য কমিশন, এরপর সংলাপ

বাংলাদেশকে দুঃসংবাদ দিল গ্লোবাল পিস ইনডেক্স

সাত কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হচ্ছে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’

আগে নিজের সংশোধন তারপর দেশ

অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক পোস্ট গ্রাজুয়েট চিকিৎসকদের

অনলাইনে সংশোধিত রিটার্ন জমার সুবিধা চালু করল এনবিআর

গুলিবিদ্ধ অভিনেতা আজাদ, আহত মা-স্ত্রী

একই ব্যক্তি টিভি ও পত্রিকার মালিক হতে পারবেন না, সাংবাদিকের যোগ্যতা হবে স্নাতক

  • ফেসবুকে আমরা

    Facebook Pagelike Widget
  • আরও খবর: জাতীয়

    সেদিন বিজয় দেখেছিল জনতা

    জুলাইয়ের দায়দেনা

    ‘শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো দেখেই মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো, সমন্বয়কদের ডাকে নয়’

    সরকারি চাকুরেদের ঘুষ প্রবণতা বাড়ছে

    আইনশৃঙ্খলার অবনতি: অপরাধীর খুঁটি রাজনৈতিক দল, মব দমনে ব্যর্থ পুলিশ

    ৩ আগস্ট আমিই প্রথম প্রফেসর ইউনূসের সাথে যোগাযোগ করি : সাদিক কায়েম