প্রবাস

নিরবে চলে গেলেন লস এন্জেলেস প্রবাসী চিত্রকর, কবি ও সাহিত্যিক কাজী হাবিব

  সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু ২৯ নভেম্বর ২০২৫ , ১:০৬:২৯

নিরবে চলে গেলেন লস এন্জেলেস প্রবাসী চিত্রকর, কবি ও সাহিত্যিক কাজী হাবিব (১৯৫৬-২০২৫)।

প্রতিবেদক: সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু
বুধবার, ২৬শে নভেম্বর, ২০২৬, লস এন্জেলেস।
————————————————
লস এন্জেলেস শহরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশকিছু প্রতিভাবান সমাজকর্মী এবং পেশাদার ব‍্যক্তিত্বের সাথে আমার সরাসরি পরিচয় হবার সুযোগ হয়েছিলো। যার মধ‍্যে কাজী হাবিব ছিলেন একজন।

গেলো ২৬শে নভেম্বর, ২০২৫ লস এঞ্জেলেসে শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিলাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৯ বছর। কয়েকযুগ ধরে তিনি লস এন্জেলেস শহরে বসবাস করছিলেন।

প্রচারবিমূখ, বিনয়ী ও হাসিখুশি একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবে কাছাকাছি থেকে দেখেছি। ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষার্থী ছিলেন এবং তার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল অসাধারণ! বিশেষ করে একজন পেশাদার চিত্রকর হিসাবে যতটুকু তিনি পরিচিত, তার তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত ছিলেন একজন কবি হিসাবে। তাঁর লেখা প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতার বই প্রশংসিত হয়েছে পাঠক সমাজে।

৯০’র দশকে লস এন্জেলেস শহরে বেশ কিছু সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হতো। যার মধ‍্যে বাংলা বার্তা, একুশ, রংধনু, ভিন্নমত’ সহ বেশ কিছু বাংলা পত্রিকা। যার অধিকাশ পত্রিকার বিষয় ছিল দক্ষিন ক‍্যালিফোর্নিয়ায় বিভিন্ন শহরে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের খবরাখবর নিয়ে সংবাদ বিবরণী। কিন্তু এরমধ‍্যে কাজী হাবিব নিয়ে এলেন অনেকটা বোম ফাটানো, একটি ভিন্নধর্মী বাংলা পত্রিকা ‘আমার পক্ষে’!!! পত্রিকাটি ছিলো একটি ৮ পাতার টেবলয়েড পত্রিকা। অনেকের পাঠকের কাছে পত্রিকাটি খূব দ্রুত দৃশ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো । ‘আমার পক্ষে’ পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো, বাংলা সাহিত্য, কবিতা, গল্প আর প্রবন্ধ নিয়ে। তবে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, সে পত্রিকা আর বেশীদিন এগূতে পারেনি।

প্রয়াত কাজী হাবিব ছিলেন একজন পেশাদার চিত্রকর। তাঁর আগ্রহ ছিলো বহুলাংশে বাংলা সাহিত্যে চর্চার ক্ষেত্রে। একবার আমার দেখার সুযোগ হয়েছিলো হাবিব ভাইয়ের আর্ট স্টুডিও। রং-তুলী আর ক‍্যানভাসে পরিপূর্ন বাসার একটি অংশ জুড়ে। তবে তিনি সাহিত‍্য চর্চা ও কবিতা লেখার প্রতি প্রচুর আগ্রহ ছিলো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ একজন কবি। কাজী হাবিবের লেখা বেশ কিছু কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। হাবিব ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর কথা শুনে আজ মনে পড়ছে, একটি বিশেষ ঘটনার কথা।

সম্ভবত: ৯০ দশকের কথা। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা হতো। আমি তখন লস এন্জেলেস শহরে ‘শ‍্যাটো রিক্রিয়েশান সেন্টার’ এ প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন‍্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব‍্যস্ত। সন্ধ্যায় মিলনায়তন পরিপূর্ণ দর্শক, অনুষ্ঠান শুরু হতে আর কিছুক্ষন মাত্র বাকী। হঠাৎ হাবিব ভাই ঠিক মন্চের কাছে আমার সামনে এসে উপস্হিত। স্মিত হেসে বললেন, “ জিতু ভাই আপনাকেই আমি খূঁজছিলাম”? আমি বললাম: ‘ তাই নাকি.. বিশেষ কোন কাজ..? বললেন: ‘আছে তো অবশ্যই..!’ লক্ষ‍্য করলাম, হাবিব ভাই একটা মলাট জড়ানো কিছু একটা আমার কাছ থেকে আড়াল করার চেস্টা করছেন!

মিলনায়তনের দর্শকেদের হট্টগোলের কারণে একটু উচ্চস্বরে হাবিব ভাই বলে উঠলেন, ‘জিতু ভাই, আপনার জন‍্য একটা বিশেষ উপহার নিয়ে এসেছি এবং মনে হয় আপনি পছন্দ করবেন’! কথা শেষ না হতেই তিনি হাতে মলাট মাখানো একটা প‍্যাকেট আমার হাতে তুলে দিলেন আর দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন! সম্ভবত: আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন‍্য।

কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দ্রুত ওঁনার সামনেই মলাট খুলে দেখি, একটা ফ্রেমে ওঁনার নিজের হাতে আঁকা আমার একটি সাদা-কালো জীবন্ত ছবি! ভেবেছিলাম হয়ত এটি একটি পেন্সিল স্কেচ! তিনি বললেন, ‘ না এটি পেন্সিল দিয়ে কোন স্কেচ নয়… ‘। জানা গেলো, শুধু কয়লা দিয়ে তিনি এ ছবি এঁকেছেন? আমি তখন অনেকটা বাঁকরুদ্ধ!! কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কয়লা দিয়ে কখনো স্কেচ তৈরি হয়, সেটা আজই জানলাম! যাহোক, কৌতূহল বশে জিজ্ঞাসা করলাম, এ শহরে আপনারতো অনেক পরিচিত রয়েছে, কিন্তু হঠাৎ আমাকে নিয়ে কেন ছবি আঁকা? উত্তরে তিনি বললেন, “ কথাটা অবশ্য সত্যি, তবে আমার প্রিয়জনদের তালিকায় হাতে গোনা বেশ কয়েকজন রয়েছেন, যাঁদের ছবি আমি কয়লা দিয়ে এঁকেছি তাদের হাতে তুলে দেবো বলে। এ তালিকায় আপনিও আমার একজন অত্যন্ত প্রিয়জন ব‍্যক্তি!” সেদিনের স্মৃতি এখনও আমার চোখে জ্বলজ্বল করছে।

দোয়া করি, আল্লাহ যেনো ওঁনাকে বেহেশত নসীব করেন । আমিন।

আরও খবর