টালমাটাল অর্থনীতির বছর

ডলার সংকটের চাপে অসহায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা

আলোচনায় ছিল ব্যাংকের অনিয়ম দুর্নীতি

 মানিক মুনতাসির | বাংলাদেশ প্রতিদিন

টালমাটাল অর্থনীতির আরেকটি বছর পার করল দেশবাসী। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সময়টাই সামষ্টিক অর্থনীতি ছিল অস্থির ও সংকটাপন্ন। এমনকি বছর শেষে সংকটগুলো আরও তীব্র হয়েছে। ডলার সংকট আর মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল বছরজুড়েই।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯ তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯ তম যা দক্ষিণ এশিয়ায় ২য়। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে ৬.৩ শতাংশ হার ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭ম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি

খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য ভুগিয়েছে সব শ্রেণির মানুষকেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি শত চেষ্টায়ও।  

আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিও। একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর ডলার সংকটের কারণে অসহায় অবস্থায় পড়েন ব্যবসায়ীরা।

এর ফলে উল্লেখ করার মতো আসেনি নতুন কোনো বিনিয়োগ। তৈরি হয়নি তেমন কোনো কর্মসংস্থান। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটকে করেছে তীব্র থেকে তীব্রতর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।

তার আগের মাস নভেম্বরে যেটা ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর চলতি বছরের নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে।  

অবশ্য নভেম্বর ২০২৩-এ খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবরে যা ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে বছর শুরু হলেও শেষ হতে যাচ্ছে ২ অঙ্কের কাছাকাছি নিয়ে।আবার নতুন একটি বছর ২০২৪ শুরু হতে যাচ্ছে সেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়েই। চলতি বছরই মূল্যস্ফীতির চাপ ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। যদিও গত দুই মাসে তা সামান্য কমেছে। 

গত বছরের ডিসেম্বরে ও চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১০৫ টাকা; যা তার আগের বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৮৫-৮৬ টাকা। আর গত ২৪ ডিসেম্বর প্রতি ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। যদিও ব্যাংকের বাইরে এ ডলারের দাম ১২৪ টাকার বেশি। ২০ ডিসেম্বর, ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ তা দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসেবে এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। 

এদিকে ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানার চেষ্টা করা হয়েছে সারা বছরই।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি ৯০ লাখ (১৪.৭৫ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। তার পরও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত সূচক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছেই। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কাক্সিক্ষত হারে বাড়াতে না পারা।  

অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির তথ্যমতে, দেশের ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ সময়ে যে পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। ফলে দেশের ব্যাংক খাতও আলোচনায় ছিল বছরজুড়েই। সে আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলছে।

 অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক ধারায় ছিল সারা বছর; যা এখনো বিদ্যমান। মূল্যস্ফীতির উচ্চচাপ, রিজার্ভ নামছে প্রতিদিনই। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। বছরজুড়েই ডলারের দাম বেড়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায়নি শত চেষ্টায়ও। রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি বেড়েছে। সরকারের বাজেট বাস্তবায়নও চলছে ঢিমেতালে।  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলাম এখনো সেখানেই আছি। আমাদের ডলারের বাজারে নিয়ন্ত্রণ করে বাফেদা ও এবিবি যেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকার কথা। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো কৌশল আমরা নিতে পারিনি। ফলে চলতি বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে ছিল চরম বিশৃঙ্খলা, যা এখনো বিদ্যমান। ফলে আগামী বছরটা যে অর্থনীতির জন্য ভালো যাবে তা প্রত্যাশা করা যায় না। ’ 

এদিকে এক বছরে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের চাপও। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে। দেশের বৈদেশিক ঋণ ২০২৩ সালের জুনের শেষে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শুরুতে ২০০৯ সালের জুনে ছিল ২৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি ঋণ বাড়ার পেছনে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর দেশটির ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি এটাকে অদূরদর্শী, অতিমূল্যায়িত এবং অতিদুর্নীতিপরায়ণ উন্নয়ননীতি বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।