আইন-আদালত

আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষা, প্রস্তুতিতে যা যা করতে পারেন

  প্রথম আলো ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ১২:৪৫:০৩

আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষা, প্রস্তুতিতে যা যা করতে পারেন

লেখা:রিয়াজুর রহমান

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির (এনরোলমেন্ট) এমসিকিউ পরীক্ষা ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে। এই পরীক্ষায় প্রার্থীদের জুতসই প্রস্তুতির জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী রিয়াজুর রহমান।

এমসিকিউ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সাকল্যে সময় আছে প্রায় এক সপ্তাহের মতো। এর মধ্যে সাত বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক পরীক্ষার্থী শেষ সময়ে এসে অগোছালো ও পরিকল্পনাবিহীন পড়াশোনা করেন। কার্যত বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির এমসিকিউ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার হার বেশি। তবে বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী প্রস্তুতি আপনাকে অনেকের চেয়ে এগিয়ে রাখবে।

সাধারণত আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষা তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১০০ নম্বরে। প্রশ্ন আসে ৭টি বিষয়ে। ১০০ নম্বরের বহুনির্বাচনী পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ নম্বর পেলেই আপনি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় বসতে পারবেন। তবে নেগেটিভ নম্বর থাকায় পরীক্ষার্থীদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

শুরুতেই তামাদি আইন ১৯০৮, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এবং বার কাউন্সিল আদেশ ও বিধিমালা ১৯৭২-এর মতো ছোট আইনগুলো পড়ে ফেলতে হবে। সিলেবাসের সাত বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে সহজ এই আইনগুলো। তবে সহজ হলেও গুরুত্ব অনেক। তিনটি আইন থেকে মোট ২৫ নম্বরের প্রশ্ন আসবে। পরীক্ষার্থীরা চাইলে এসব বিষয় থেকে পুরো নম্বরই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ পাস মার্কের অর্ধেক নম্বর। যখন দেখবেন পাস মার্কের অর্ধেক নম্বর হাতের তালুর মধ্যে, তখন আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যাবে। বাকি বিষয়গুলো দুশ্চিন্তামুক্তভাবেই প্রস্তুতি নিতে পারবেন।

তামাদি, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ও বার কাউন্সিল অর্ডার

তামাদি আইন ১৯০৮ একটি পদ্ধতিগত আইন। আইনটি দেওয়ানি মোকদ্দমা এবং ফৌজদারি মামলার আপিলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়। এতে ৩২টি ধারা ও ১৮৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ধারাগুলোর মধ্যে তামাদি মেয়াদ শেষে মামলা দায়ের, আদালত বন্ধ থাকা অবস্থায় তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে করণীয়, বিলম্ব মওকুফ, আইনগত অপারগতা, তামাদি গণনা, যেভাবে তামাদি মেয়াদের গণনা করতে হয়, এখতিয়ারবিহীন আদালতে মামলা দায়ের, কার্যধারা স্থগিত থাকার সময় বাদ দেওয়ার নিয়ম, প্রতারণার ফলাফল, লিখিত প্রাপ্তিস্বীকারের ফলাফল, দেনা পরিশোধের ফলাফল, অবিরাম চুক্তিভঙ্গ, সুখাধিকার অর্জন ও সম্পত্তির অধিকার বিলুপ্তিসংক্রান্ত টপিকগুলো ভালো করে পড়তে হবে। এ ছাড়া ৯১, ৯২, ১০৩, ১১৩, ১১৪, ১২০, ১৪২, ১৫০, ১৫৭, ১৬৯, ১৮২ অনুচ্ছেদগুলো শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে যেতে হবে। ঘুরেফিরে এসব ধারা ও অনুচ্ছেদ থেকেই প্রশ্ন আসে।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭–কে ন্যায়পরায়ণতা আইনও বলা হয়। মূলত এটি প্রতিকারমূলক বা তত্ত্বগত আইন। মাত্র ৫৭টি ধারা নিয়ে গঠিত আইনটি। এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার, স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি দখল পুনরুদ্ধার, যেসব চুক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করা যেতে পারে, যেসব চুক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করা যায় না, কতিপয় ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ মঞ্জুরের ক্ষমতা, অরেজিস্ট্রিকৃত চুক্তিপত্র কার্যকরযোগ্য নয়, সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনে ডিক্রি প্রদান; যাদের পক্ষে চুক্তি কার্যকর করা যায়, যাদের পক্ষে চুক্তি কার্যকর করা যায় না; দলিল সংশোধন, চুক্তি রদ, দলিল বাতিল, ঘোষণামূলক মামলা, চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা, কখন কখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং নেতিবাচক চুক্তি পালন করার জন্য নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত ধারাগুলো পড়লেই হবে।

অপর দিকে বার কাউন্সিল আদেশ ও বিধিমালা ১৯৭২–এর জন্য বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন সমাধান করলে পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব। এ ছাড়া বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অঙ্গসংগঠন, বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল, বার কাউন্সিলের সদস্য, বার কাউন্সিলের নির্বাচন, বার কাউন্সিলের কমিটি, অ্যাডভোকেট হওয়ার যোগ্যতা, অ্যাডভোকেটদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো পড়তে হবে। সঙ্গে পেশাগত সদাচরণ ও নিয়মানুবর্তিতা বিধি থেকে অন্য আইনজীবীর সঙ্গে আচরণ, মক্কেলের প্রতি কর্তব্য, আদালতের প্রতি কর্তব্য ও জনসাধারণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো ভালোভাবে দেখে যেতে হবে।

সাধারণত আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষা তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা ১০০ নম্বরে। ১০০ নম্বরের বহুনির্বাচনী পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ নম্বর পেলেই আপনি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় বসতে পারবেন।

সাক্ষ্য আইন ১৮৭২

১৬৭টি ধারা নিয়ে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২। এটি পদ্ধতিগত আইন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি—উভয় শ্রেণির মামলার ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য। আইনজীবী তালিকাভুক্তি এমসিকিউ পরীক্ষায় এ আইন থেকে ১৫ নম্বরের প্রশ্ন আসে। আইনের সংজ্ঞা, অনুমান, ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা, স্বীকৃতি, দোষ স্বীকারোক্তি; যেসব ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে তলব করা যায় না, তাদের বিবৃতি; বিশারদের অভিমত, যেসব ঘটনা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই, মৌখিক সাক্ষ্য, দালিলিক সাক্ষ্য, সত্যায়িত দলিলের প্রমাণ, প্রমাণের দায়িত্ব, সাক্ষীসমূহ, সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, ইঙ্গিতবাহী প্রশ্ন, বৈরী সাক্ষীর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো ভালো করে পড়তে হবে। একটি বিষয় মনে রাখবেন, প্রতিটি আইন পড়ার সময় অবশ্যই মূল আইনের দেওয়া ব্যাখ্যা ও উদাহরণগুলো পড়বেন। অনেক সময় ব্যাখ্যা ও উদাহরণ থেকেও প্রশ্ন আসে।

দণ্ডবিধি আইন ১৮৬০

বিদ্যমান যেসব আইনের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিচারব্যবস্থা চলছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দণ্ডবিধি আইন। আইনটিতে বিভিন্ন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধের ধরন অনুসারে শাস্তি ও জরিমানা প্রয়োগের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। কার্যতই তালিকাভুক্তকরণ পরীক্ষায় এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন আসে ২০ নম্বরের। ৫১১টি ধারা নিয়ে গঠিত আইনটি বেশ বড়ও বটে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ধারা পড়লে ২০ নম্বরের মধ্যে সম্মানজনক নম্বর পাওয়া সম্ভব।

সাধারণত প্রতিবারই সংজ্ঞা, সাধারণ ব্যাখ্যা, যৌথ দায়, শাস্তি ও অর্থদণ্ডের ধারাগুলো থেকে প্রশ্ন থাকে। এ ছাড়া সাধারণ ব্যতিক্রম, অপরাধের সহায়তা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, বেআইনি সমাবেশ, মিথ্যা সাক্ষ্যদান, অপরাধমূলক নরহত্যা ও খুন, আঘাত–সম্পর্কিত অপরাধ, অবৈধ বাধা ও আটক, অপহরণ, চুরি, বলপূর্বক গ্রহণ, দস্যুতা, ডাকাতি, অসাধুভাবে সম্পত্তি আত্মসাৎ ও তছরুপ করা, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা, অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ, ক্ষতিসাধন, মানহানি, জালিয়াতি ও ব্যভিচারসংক্রান্ত ধারাগুলো থেকে আলাদা প্রশ্ন থাকতে পারে। তাই শেষ সময়ে এগুলো ভালো করে পড়তে হবে। ধর্ষণসংক্রান্ত ধারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে। এবার এ–সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সময়ে সরাসরি শিরোনাম তুলে দিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তাই এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি

দেওয়ানি কার্যবিধি আইন ১৯০৮ ও ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ থেকে এমসিকিউ পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকবে ৪০ নম্বরের। এর মধ্যে ধারাভিত্তিক প্রশ্নের পাশাপাশি সমস্যামূলক, রচনামূলক প্রশ্ন বেশি থাকে। ফলে উভয় আইন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধারা, ধারার শিরোনাম, সংশ্লিষ্ট ধারার উপধারা, ব্যাখ্যা ও উদাহরণগুলো বেশি পড়তে হবে। দুই বিষয়ে নতুন করে কোনো টপিক এই মুহূর্তে পড়ার দরকার নেই। পূর্বে যেসব বিষয় পড়েছেন, সেগুলো নিয়মিত অধ্যয়ন করুন।

দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের সংজ্ঞাসহ ৯, ১০, ১১, ১৫-২১, ২৭, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৮৯কগ, ৯৬, ১০৪, ১১৫, ১৫১ ও ১৫২ ধারাগুলো ভালো করে পড়তে হবে। এ ছাড়া আদেশ অংশে মামলার পক্ষ, প্লিডার নিয়োগ, মামলা দায়ের ও সমন, প্লিডিংস, আরজি এবং লিখিত জবাব, পক্ষদ্বয়ের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতির ফলাফল, আবিষ্কার/উদ্‌ঘাটন, স্বীকারোক্তি, বিচার্য বিষয় গঠন, রায় ও ডিক্রি, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, রায়ের পূর্বে আটক ও ক্রোক, রিসিভার নিয়োগ, আপিল, রেফারেন্স, রিভিউ, রিভিশনের বিষয়গুলো ভালো করে পড়তে হবে। প্রতিটি আদেশের শিরোনাম, আদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিধি মনে রাখতে হবে।

ফৌজদারি কার্যবিধি থেকে অবশ্যই সংজ্ঞাগুলো পড়তে হবে। এ ছাড়া ফৌজদারি আদালত, আটক, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, অপরাধ দমন, ধারা ১৪৪-১৪৬, এফআইআর, আমলযোগ্য মামলা, আমল অযোগ্য মামলা, ফৌজদারি মামলা আমলে নেওয়ার পদ্ধতি, অভিযোগ গঠন, ফৌজদারি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া (ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও দায়রা আদালত), আপিল, রিভিশনের ক্ষমতা, জামিন, ফৌজদারি মামলা স্থানান্তর ও ধারা ৫৬১ক বিষয়গুলো ভালো করে না পড়ে পরীক্ষা হলে যাওয়া বোকামি হবে।

তামাদি, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ও বার কাউন্সিল অর্ডার থেকে ২৫ নম্বরের মধ্যে ২০ নম্বর, সাক্ষ্য আইনে ১৫ নম্বর থেকে ১০ নম্বর, দণ্ডবিধি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি তিনটি বিষয়ে ৬০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ২০ নম্বর পেলেই আপনার মোট নম্বর হবে ৫০। অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষার জন্য উত্তীর্ণ হবেন।

আরও খবর