ধর্ম

মসজিদ পরিচালনা কমিটির দায়দায়িত্ব

  মুফতি এনায়েতুল্লাহ ১১ জানুয়ারি ২০২৫ , ৪:৫১:১৩

মসজিদ পরিচালনা কমিটির দায়দায়িত্ব

মুফতি এনায়েতুল্লাহ

মসজিদ পরিচালনা কমিটির দায়দায়িত্ব

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় গমন করেই মসজিদে নববি গড়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন মসজিদে নববি ছিল ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র, জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার স্থল, মামলা-মোকদ্দমার মীমাংসা ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র। শুধু ইবাদত-বন্দেগি নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মসজিদ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মসজিদগুলো আল্লাহর। অতএব, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কারও ইবাদত কোরো না।’ – সুরা জিন : ১৮

মসজিদ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান, সেই মসজিদকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে বিরোধ। নতুন মসজিদ নির্মাণ, নামকরণ, ইমাম নিয়োগ বা পরিবর্তন, পরিচালনা কমিটির পদ-পদবি প্রাপ্তি, অনুদানের টাকার হিসাব চাওয়াসহ মসজিদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধের জেরে রক্তারক্তি ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

সম্প্রতি এক সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সারা দেশে মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনায় ২২ মাসে ২৭টি সংঘর্ষে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। নারীসহ আহত ৩০২ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের ১৮টি জেলায় এসব ঘটনা ঘটে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই ২২ মাসে ঘটা ২৭টি ঘটনায় ২০টির মতো মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১০৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি জামিনে রয়েছেন। মসজিদকেন্দ্রিক কিছু ঘটনায় বিরোধ এখনো চলছে। বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মসজিদ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিচালিত হচ্ছে।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে সমাজে মসজিদকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়টি। আমরা জানি, মসজিদের উন্নয়ন, নির্মাণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় একটি কমিটি থাকতে হয়। যেহেতু মসজিদগুলো সমাজের লোকজন পরিচালনা করেন, আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে না। মসজিদ পরিচালনা কমিটির কাজ হলো- মসজিদে জুমার নামাজ, প্রাক-খুতবা, খুতবা, ওয়াক্তিয়া নামাজ, ঈদের নামাজ ও জানাজার নামাজের ব্যবস্থা করা। পবিত্র কোরআন শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, সংশ্লিষ্ট এলাকার শিশুদের বুনিয়াদি ইসলামি শিক্ষা ইত্যাদির আয়োজন করা। মসজিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব, নগদ অর্থ ও অন্যান্য স্থায়ী-অস্থায়ী যাবতীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত মনিটরিং ও ফলোআপ করা। মসজিদের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ। যথাযথ সম্মানীর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া। মসজিদ এলাকার অসহায়, বিধবা, বৃদ্ধ, গরিব-মিসকিন, এতিম, অন্ধ ও পঙ্গুদের সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ নানাবিধ কল্যাণকর কাজ করতে হয়।

কিন্তু এখনকার মসজিদ কমিটি এসব জনকল্যাণমুখী কাজ বাদ দিয়ে মসজিদ বড় করা, মসজিদে এসি লাগানো, বড় বড় মাহফিলের আয়োজন নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। যা সমাজের জন্য কল্যাণকর নয়। প্রায়ই দেখা যায়, সমাজের একশ্রেণির লোক নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে এলাকায় মসজিদ থাকলেও নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করেন। কেউ কেউ মসজিদ কমিটির নেতৃত্বে আসতে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বস্তুত মসজিদ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে যখন ব্যক্তিস্বার্থ, আর্থিক বিষয়, পদ-পদবির বিষয় চলে আসে, তখনই বিরোধ সৃষ্টি হয়। মসজিদ পরিচালনা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা মেনে চললে মসজিদকেন্দ্রিক এ জাতীয় বিরোধ অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

কমিটি মসজিদ পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মসজিদের যথাযথ ব্যবহার, মসজিদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নতি নির্ভর করে মসজিদ কমিটির যোগ্যতা ও সদিচ্ছার ওপর। ইসলাম মনে করে, মসজিদ পরিচালনা কমিটি কোনো পদ নয়; বরং আল্লাহর ঘরের খেদমতের (সেবা) সুযোগ মাত্র। কিন্তু সঠিক জ্ঞানের চর্চা না থাকায় এবং নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন মনোভাবাপন্ন লোক পাওয়া কঠিন। যে কারণ মসজিদকেন্দ্রিক সংঘর্ষগুলো ঘটছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, মসজিদ কমিটির পদকে নেতৃত্ব মনে করা চরম বোকামি; বরং কমিটির কোথাও জায়গা হলে এটাকে নিছক খেদমত (সেবার সুযোগ) মনে করা। এ খেদমত আল্লাহর ঘরের খেদমত, মুসল্লিদের খেদমত। তাই দুনিয়ার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছাড়া মুক্তমনে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছায় ইবাদত মনে করা। সামাজিক পদমর্যাদা বৃদ্ধির অভিলাষে কমিটিতে যোগ দেওয়া হারাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা মসজিদ কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ‘একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ইমান রাখে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারা হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ -সুরা তাওবা : ১৮

ইবনে কাসির (রহ) বলেন, আয়াতে আবাদ শব্দ দ্বারা মসজিদ পরিচালনার বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। কে বা কারা মসজিদ পরিচালনা করবে তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ মসজিদের কমিটির অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশের অধিকাংশ মসজিদের কমিটি দখল করে আছেন- দুর্নীতিবাজ, সুদখোর ও ঘুষখোর মানুষরা। মসজিদ কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারিসহ অন্যান্য পদে এমন অনেকেই আছেন, যারা জুমার নামাজটাও ঠিকমতো আদায় করেন না, ওয়াক্তিয়া নামাজ তো দূরের কথা! তা ছাড়া সব ধরনের অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। অথচ ক্ষমতাবলে তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি! এটা আমানতের খেয়ানত, চরম দায়িত্বহীন আচরণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন থেকে কেয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), কীভাবে আমানত নষ্ট করা হবে? তিনি বলেন, যখন অযোগ্যকে দায়িত্ব দেওয়া হবে তখন থেকে কেয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকো।’ -সহিহ বোখারি : ৬৪৯৬

ইসলামের বিধান স্পষ্ট, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় কাজ হবে বিশুদ্ধ নিয়তে তাকওয়ার ভিত্তিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে মসজিদ তাকওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে নামাজে দাঁড়ানোই আপনার জন্য অধিক সংগত।’ -সুরা তওবা : ১৩

সুতরাং মসজিদের পরিচালনা কমিটি দীনদার, সৎ, যোগ্য, আমানতদার, সুশিক্ষিত, জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করতে হবে। মসজিদকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা চালুসহ যোগ্য ইমাম-খতিব নিয়োগ দিয়ে মসজিদগুলোকে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবন্ত করতে হবে। মসজিদকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দেখানোর মাধ্যম বানানো যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, মসজিদের সুযোগ-সুবিধাবৃদ্ধি, কারুকাজ ও যোগ্য ইমাম-খতিব নিয়োগ নিয়েও বিস্তুর আলোচনা দরকার।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলাম বিষয়ক গবেষক

muftianaet@gmail.com

আরও খবর