জাতীয়

বাংলাদেশ ডাক আইন হালনাগাদ ও সংশোধন করা হচ্ছে

  ডাক বিভাগ ২৫ অক্টোবর ২০২৫ , ৮:৩৫:১১

বাংলাদেশ ডাক আইন হালনাগাদ ও সংশোধন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ডাকের ডিজিটাল রূপান্তর, আধুনিক ঠিকানা ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন সহ যে কোন ধরনের মাইগ্রেশন জনিত ঠিকানা ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত উপাত্তের নিরাপত্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা জোরদার করার উপর গুরুত্ব তৈরিতে বাংলাদেশ ডাক আইন হালনাগাদ ও সংশোধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ আইনটিকে সম্পূর্ণ নতুন রুপ দেয়া হচ্ছে যা ‘ডাকসেবা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে অভিহিত হবে এবং পূর্ববর্তী Post Office Act, 1898 কে প্রতিস্থাপন করবে। আমরা মনে করি সংশোধনীসমূহের মধ্যে কয়েকটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসছে।

যুগান্তকারী পরিবর্তনসমূহ:

১. আধুনিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো

• নিয়ন্ত্রণ উইং গঠন: পুরাতন আইনে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের ধারণা থাকলেও, নতুন অধ্যাদেশে বাংলাদেশ ডাকের অধীনে একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়োজিত একটি নিয়ন্ত্রণ উইং (Regulation Wing) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা সকল বাণিজ্যিক ডাক ও কুরিয়ার অপারেটরদের লাইসেন্স প্রদান ও তাদের সেবা প্রদান ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করবে।

• প্রতিযোগিতা ও বৈষম্যহীনতার তদারকি: নিয়ন্ত্রণ উইং এই খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করবে। বিশেষত, বাংলাদেশ ডাক যেন সার্বজনীন সেবার জন্য প্রাপ্য সরকারি সংস্থান অন্য প্রতিযোগিতামূলক সেবার ক্ষতিপূরণে ব্যবহার না করে, তার জন্য আলাদা হিসাব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

• লাইসেন্সবিহীন কার্যক্রমের জন্য কঠোরতম জরিমানা: বৈধ লাইসেন্স ছাড়া ডাক, কুরিয়ার বা পার্সেল ব্যবসা পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ প্রশাসনিক জরিমানা পূর্বের ৫০ হাজার টাকা (বা পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে ২ লক্ষ টাকা) থেকে বাড়িয়ে অনূর্ধ্ব ১০ লক্ষ টাকা (দশ লক্ষ) পর্যন্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

২. ডিজিটাল রূপান্তর এবং উপাত্ত সুরক্ষা

• ডিজিটাল ডাকটিকিট ও ই-সেবা: প্রচলিত ডাকটিকিটের পাশাপাশি ডিজিটাল ডাকটিকিট বা ই-স্ট্যাম্পিং চালু করা হয়েছে। গ্রাহক অনলাইনে পরিশোধ করে সুরক্ষিত ডিজিটাল কিউআর কোড বা বারকোড পাবেন, যা স্বতন্ত্র ছাপানো মাধ্যম বা যে কোনো ডিভাইসে প্রদর্শিত হলেও বৈধ ডাকটিকিটের সমতুল্য আইনি স্বীকৃতি পাবে।

• ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা: নতুন আইনে ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর অধীন সকল নীতি ও অধিকার প্রযোজ্য করা হয়েছে। অপারেটরদেরকে গ্রাহকের তথ্য শুধু সেবা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা, অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুছে ফেলা (destroy), এবং সাইবার আক্রমণের শিকার হওয়া থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রযুক্তিগত ও সাংগঠনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা (যেমন এনক্রিপশন) গ্রহণের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।

• কেন্দ্রীয় ট্র্যাকিং ও আন্তঃপরিবাহিতা: একটি ডিজিটাল সেন্ট্রাল লজিস্টিক্স ট্র্যাকিং প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সকল বাণিজ্যিক অপারেটরের আন্তঃপরিচালন (Interoperability) নিশ্চিতকরণের বিধান করা হয়েছে, যাতে গ্রাহকরা সহজে ট্র্যাকিং তথ্য পেতে পারেন।

৩. বাংলাদেশ ডাকের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি

• জরুরী সেবা হিসাবে ঘোষণা: ডেজিগনেটেড অপারেটর কর্তৃক পরিচালিত ডাকসেবা জাতীয় নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য হওয়ায় এটিকে জরুরী সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই মর্যাদার কারণে জাতীয় সংকটকালে ডাক যানবাহন এবং আবশ্যিক জনবল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক চলাচল ও প্রবেশাধিকার সুবিধা লাভ করবে।

• জাতীয় অবকাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি: বাংলাদেশ ডাকের নেটওয়ার্ককে কেবল একটি সেবা প্রদানকারী ব্যবস্থা হিসেবে নয়, বরং দেশের জাতীয় সংযোগ, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক লেনদেনের মেরুদণ্ডস্বরূপ একটি অপরিহার্য ন্যাশনাল ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

• সরকারি যোগাযোগের অগ্রাধিকার: কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকারের সকল সংস্থা, মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহকে দাপ্তরিক চিঠি, ডকুমেন্ট এবং স্বল্প ওজনের পার্সেলসহ পরীক্ষার খাতা ও অন্যান্য সংবেদনশীল সরকারি পার্সেল দেশের অভ্যন্তরে বা বিদেশে প্রেরণের জন্য ডেজিগনেটেড অপারেটরের ডাকসেবা ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

• চিফ কন্ট্রোলার অফ স্ট্যাম্পস দপ্তরের প্রতিষ্ঠা: সকল প্রকার পোস্টাল ও নন-পোস্টাল স্ট্যাম্পের (রাজস্ব ও অন্যান্য স্ট্যাম্প) প্রশাসনিক, আর্থিক ও লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ডাকের অধীনে চিফ কন্ট্রোলার অফ স্ট্যাম্পস এর দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

৪. নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ

• ইলেকট্রনিক অগ্রিম ডাটা (EAD) আবশ্যিকতা: দেশের সীমান্ত অতিক্রম করা সকল ডাক, কুরিয়ার বা পার্সেলের জন্য কাস্টমস ও নিরাপত্তা সংস্থার নিকট ইলেকট্রনিক অগ্রিম তথ্য (যেমন প্রেরক-প্রাপক, মূল্য, সামগ্রীর বর্ণনা) পূর্বেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রেরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

• কেওয়াইসি (KYC) যাচাইকরণ: ডাক ও পার্সেল সেবার অপব্যবহার রোধে, বিশেষত বিদেশগামী বা উচ্চমূল্যের অভ্যন্তরীণ চালানের ক্ষেত্রে, প্রেরক ও প্রাপকের সরকারি শনাক্তকরণ দলিল (জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট) পরীক্ষা ও তথ্য নথিভুক্ত করার কেওয়াইসি যাচাইকরণ (KYC) প্রথায় ডাক কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত ঠিকানার ব্যবহার আনুষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

• সক্রিয় নিরাপত্তা কৌশল: ডেজিগনেটেড অপারেটর ও সকল লাইসেন্সধারী অপারেটরদের প্রো-অ্যাকটিভ নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে কর্মীদের নিয়মিত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ, মেইল অফিস ও কেন্দ্রে এক্স-রে স্ক্যান এবং জরুরি অবস্থার জন্য কন্টিনজেন্সি পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত।

৫. বাংলাদেশ ডাকের আর্থিক সেবায় নতুন দিগন্ত: সুরক্ষিত ও আধুনিক সঞ্চয় ও বীমার সুযোগ

বাংলাদেশ ডাকের নতুন আইন অনুযায়ী, ডাক জীবন বীমা এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক এখন “অধিকারী ডাকসেবা” হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক লেনদেন ও সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।
ডাক জীবন বীমার মাধ্যমে করা নাগিরিকের প্রতিটি পলিসি এখন বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি সহকারে পরিচালিত হবে, যা এটিকে দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা গ্যারান্টিযুক্ত সঞ্চয়ী কার্যক্রমে পরিণত করেছে। এখানে পলিসি-গ্রহীতাদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ তহবিল পরিচালিত হবে, যা লাভ-লোকসান নির্বিশেষে কাজ করবে।
একইভাবে, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সকল আর্থিক সেবার সঞ্চিত অর্থ এখন সরকারি কোষাগারে জমা থাকবে এবং এই অর্থ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে ব্যবহৃত হবে। এর বিপরীতে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে আমানতকারীদের মুনাফা নির্ধারিত হবে, যা সঞ্চয়কে আরও সুরক্ষিত ও লাভজনক করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশ ডাক তার সকল আর্থিক সেবা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।

এই পরিবর্তনগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা আমাদের আর্থিক সেবাগুলোকে আরও সুরক্ষিত, স্বচ্ছ এবং সহজলভ্য করে তুলবে।

৬. প্রবাসী ও অনিবাসী ভোটারের জন্য পোস্টাল ব্যালট

গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধিত) আইন ২০২৩ অনুযায়ী সকল ধরনের নির্বাচনে প্রবাসী ও অনিবাসী ভোটারের জন্য পোস্টাল ব্যালট পরিবহনসহ নির্বাচনী ব্যবস্থায় ডাকসেবার ব্যবহারসহ ফলাফল পরিবহনে ডেজিগনেটেড অপারেটর কর্তৃক পরিচালিত ডাকসেবা ব্যবহার এর উপর জোর দেয়া হয়েছে।

৭. ঠিকানা আর্কাইভিং

ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে সকল নাগরিকের ঠিকানাসমূহকে এমনভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হইবে, যাহাতে ডিজিটাল অ্যাড্রেস তৈরি হইবার পাশাপাশি ঠিকানা-কেন্দ্রিক ফ্যামিলি-ট্রি ম্যাপিং সহ জিও-ফেন্সিং নির্ধারন করা হইবে; এবং এইসব ডেটার স্থায়ী লাইফ-সাইকেল নির্ধারণ করিয়া ডিজিটাল আর্কাইভিং করা হইবে। অনুরূপ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এমনভাবে পরিচালিত হইবে, যাহাতে জলবায়ু পরিবর্তন বা নদীভাঙ্গনসহ অন্যান্য মাইগ্রেশনজনিত কারণে ঠিকানা হারানোর প্রেক্ষিতে (যেমন চর বিলীন হওয়া ও জেগে ওঠা কিংবা ভূমি পুনরুদ্ধার ইত্যাদি) পুনরায় যথাযথভাবে ঠিকানা চিহ্নিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায়।

আরও খবর