আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিলে আসছে বিল: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ কী?

  ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৯:৩৫:০৩

৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

ওহিও সিনেটর আমেরিকানদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ করার জন্য একটি বিলটি উত্থাপন করেছেন।

বিলটি পাস করানোর এক বছরের মধ্যে দুটি পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের একটি বা অন্য পরিচয় ত্যাগ করার জন্য লিখিত বিবৃতি জমা দিতে হবে।

১ ডিসেম্বর, ওহাইওর রিপাবলিকান সিনেটর বার্নি মোরেনো ২০২৫ সালের এক্সক্লুসিভ সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট উত্থাপন করেন, যা আমেরিকান নাগরিকদের একই সাথে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ নিষিদ্ধ করবে। “যুক্তরাষ্ট্র এবং শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা সম্মানের বিষয় ছিল,” কলম্বিয়ান বংশোদ্ভূত মোরেনো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। “আমেরিকা প্রথম এবং শুধুমাত্র আমেরিকা। চিরতরে দ্বৈত নাগরিকত্ব শেষ করার সময় এসেছে।”

বিল অনুসারে, বিলটি কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকত্বধারীদের তাদের মার্কিন- অথবা বিদেশী নাগরিকত্ব ত্যাগ করার জন্য লিখিত বিবৃতি জমা দিতে হবে। যারা তা মেনে চলবে না তারা স্বেচ্ছায় তাদের মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছে বলে গণ্য হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হওয়ার ১৮০ দিন পর বিলটি কার্যকর হবে।

আমেরিকান সরকার দ্বৈত নাগরিকত্বের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান রাখে না, যদিও অনুমান অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০০,০০০ থেকে ৫.৭ মিলিয়নের মধ্যে দ্বৈত নাগরিক রয়েছে এবং আরও প্রায় ৪ কোটি যোগ্য।

প্রস্তাবিত আইনটি সুপ্রিম কোর্টের দ্বৈত নাগরিকত্বকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নজিরগুলিকে লঙ্ঘন করবে। ট্যালবট বনাম জ্যানসেন (১৭৯৫) রায়ে বলা হয়েছে যে বিদেশী নাগরিকত্ব অর্জনকারী মার্কিন নাগরিকদের তাদের আমেরিকান নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে না, অন্যদিকে আফ্রোয়িম বনাম রাস্ক (১৯৬৭) রায়ে বলা হয়েছে যে একজন মার্কিন নাগরিক স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ না করলে নাগরিকত্ব হারাতে পারবেন না।

হোয়াইট হাউস যখন আক্রমণাত্মক গণ-নির্বাসন নীতি চালু রেখেছে, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার মিত্ররা প্রকাশ্যে নিউ ইয়র্ক সিটির নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি সহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। গ্রীষ্মকালে, হোয়াইট হাউসে তাদের সাম্প্রতিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকের আগে, ট্রাম্প জানিয়েছিলেন যে মামদানি অবৈধভাবে দেশে আছেন, অন্যদিকে টেনেসির রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলস তাকে নির্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন।

আজকের মার্কিন আইন অনুসারে, একজন আমেরিকানকে কেবল তখনই নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে যদি তার নাগরিকত্ব “অবৈধভাবে অর্জিত” অথবা “কোনও বস্তুগত তথ্য গোপন করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল উপস্থাপনের মাধ্যমে অর্জিত” বলে প্রমাণিত হয়। তবে এটি এখনও একটি উচ্চ বিধিনিষেধ হিসাবে রয়ে গেছে, কারণ ১৪ তম সংশোধনী “এই জাতির প্রতিটি নাগরিককে কংগ্রেসের জোরপূর্বক তার নাগরিকত্ব ধ্বংসের বিরুদ্ধে রক্ষা করে, সে তার ধর্ম, বর্ণ বা জাতি যাই হোক না কেন।”

‘এক্সক্লুসিভ সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট অব ২০২৫’।

যদি এই বিল আইনে পরিণত হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকেরা কঠিন এক সংকটের মুখে পড়বেন। আইনটি কার্যকর হলে তাদের যেকোনো একটি দেশের নাগরিকত্ব বেছে নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের (আনুমানিক) মধ্যে যাঁরা দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেন, তাঁদের জীবনে এই আইন সরাসরি এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রস্তাবের মূলকথা: ‘শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই আনুগত্য’

সিনেটর মোরেনোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য হলো একজন মার্কিন নাগরিকের আনুগত্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই নিবেদিত হওয়া উচিত। দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বার্থের সংঘাত এবং বিভক্ত আনুগত্য (ডিভাইডেড লয়্যালিটিস) সৃষ্টি করে।

বিলটি আইনে পরিণত হলে যা ঘটবে

• সব দ্বৈত নাগরিককে তাঁদের বিদেশি নাগরিকত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা (সম্ভবত এক বছর) দেওয়া হবে।

• যদি তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্য দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ না করেন, তবে তাঁরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব হারাবেন।

• প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে এল, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার বিষয়ে নানা মন্তব্য করে আসছেন। সব মিলিয়ে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত আইনকে আরও কঠোর করার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত এটি।

প্রবাসী বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের (আনুমানিক) মধ্যে যাঁরা দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেন, তাঁদের জীবনে এই আইন সরাসরি এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। যদি বিলটি আইনে পরিণত হয়, তবে বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিকদের নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—
১. আর্থিক ও সম্পত্তির অধিকার
• বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বহু বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে স্থাবর সম্পত্তি, জমি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেছেন। যদি তাঁরা মার্কিন নাগরিকত্ব ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন, তবে বাংলাদেশে তাঁদের সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
• ব্যাংকিং ও লেনদেন
বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা এবং অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিদেশি হিসেবে আলাদা বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হবে।

২. যাতায়াত ও ভিসা জটিলতা

দ্বৈত নাগরিকেরা উভয় দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। বাংলাদেশি বলে ‘নো ভিসা রিকোয়ারমেন্ট’ দিয়ে আমেরিকান পাসপোর্টে সহজে বাংলাদেশে যেতে পারেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারালে তাঁদের প্রতিবার ভিসা নিতে হবে।

৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার

•  নির্বাচনে অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে বা ভোট দিতে পারবেন না।
• সরকারি চাকরি: বাংলাদেশের সরকারি চাকরি বা অন‍্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে।

৪. পরিচয়গত সংকট

• সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক বন্ধন: অনেক বাংলাদেশি-আমেরিকান নিজেদের উভয় দেশের সংস্কৃতির অংশ মনে করেন। নাগরিকত্ব ছাড়ার এই বাধ্যবাধকতা তাঁদের মধ্যে একধরনের পরিচয়গত সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং জন্মভূমির সঙ্গে তাঁদের আইনি ও মানসিক সংযোগকে দুর্বল করে দিতে পারে।

আরও খবর