আরশাদ সিদ্দিকী

এ বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই জয়ের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন হিরো আলম। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে যান। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হিরো আলম ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদ নেতা রেজাউল করিমের কাছে পরাজিত হন। এ নির্বাচনে হিরো আলমের জয়ের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়াটা অনেকের কাছে ছিল বিস্ময়। আবার অনেকেই তাঁর পরাজয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।

নিজ জেলা বগুড়ায় হেরে গিয়েও দমে যাননি হিরো আলম। পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। অংশ নিচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে। গুলশান-বনানীর উচ্চবিত্তের এলাকা রয়েছে এ আসনের সীমানায়। অবশ্য দামি জুতার তলায় নোংরা ধুলো-কাদার মতো বেশ কিছু বস্তিও রয়েছে এ আসনে। অভিজাত এলাকার ধনীদের মতো গরিব-গুর্বো বস্তিবাসীও ভোটার। তাদের ভোটের আশাতেই হয়তো হিরো আলমের প্রার্থী হওয়া। নয়তো তিনি ভালোই জানেন, উচ্চবিত্তের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজের কাছে তো তিনি অনেকটা ব্রাত্য এবং রুচিবিবর্জিত একজন মানুষ, যাদের কাছে রুচির সীমানা-চৌহদ্দি মাপমতো নির্ধারিত। চারুকলা থেকে শিল্পকলা, ছায়ানট থেকে বটতলা। এর বাইরে গেলেই তারা ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ চলছে বলে হই হই রবে চেঁচিয়ে ওঠেন। তাদেরই উন্নত নাসিকার ঠিক অগ্রভাগে নির্বাচন করার হিম্মত দেখাচ্ছেন হিরো আলম।

হিরো আলমকে উদ্দেশ করে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন নাট্য অঙ্গনের এক মহাজন। তিনি বলেছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল নাকি ৫০-৬০ বছর আগেই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে কথা বলে গেছেন। তাঁর কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই জনতা জানতে চাইতে পারে, ‘জয়নুল যদি ৫০-৬০ বছর আগেই ওই কথা বলে গিয়ে থাকেন, তাহলে এত বছর ধরে আপনারা করেছেনটা কী? এখন কেন হিরো আলমকে উদ্দেশ করে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে?

হিরো আলমকে বুঝতে হলে, হিরো আলমের জেদটা বুঝতে হলে, হিরো আলমের ঔদ্ধত্যকে বুঝতে হলে রুচির আগে বোঝা দরকার সেসব পড়ে পড়ে মার খাওয়া মানুষের অবস্থানগত পার্থক্যটা কোথায়, কতটুকু? নইলে ফাঁকতালে এস্টাবলিশমেন্টের টুকটাক সমালোচনা করে বাজার মাত করবেন, আর নরম বিছানায় গা এলিয়ে নিজের মতো করে ভালো থাকার একটি স্থিতাবস্থাই বহাল চাইবেন। নইলে জাত খোয়ানোর ভয়।

হিরো আলমদের জাত খোয়ানোর কোনো ভয়ডর নেই। তিনি একা; স্বতন্ত্র। দল নেই, বল নেই। একা হয়েও অনেক। তাদের শক্তি ওখানেই। তিনি বেসুরো গলায় গান করেন; নেচেকুঁদে অভিনয় করেন; তাতে তার কোনো হীনম্মন্যতা নেই। তার কিছু হারানোর নেই, পিছুটান নেই। এই পিছুটান না থাকাটাও উচ্চমন্যদের মনের গভীরে-গোপনে জ্বালা ধরায়। কারণ, পিছুটানের যন্ত্রণাতেই উচ্চমন্যদের দিবস-রজনী কেটে যায়।

হিরোর হিম্মতের প্রশংসা না করে উপায় নেই। তিনি বুক চিতিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের বিপক্ষে। এ দু’জন প্রার্থীর মধ্যে তুলনা অবান্তর। আরাফাত উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল, অভিজাত। অন্যদিকে হিরো অশিক্ষিত, অশোভন, অকুলীন। তবু হিরো আলম বুকের জোরেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন হেভিওয়েট প্রার্থীর বিরুদ্ধে।

হিরো আলমের স্বভাবটাই বোধ করি এমন জেদি। হিরো আলম গান গাইতে চান, কিন্তু তাঁর গানের বিদ্যা নেই। হিরো আলম অভিনয় করতে চান, কিন্তু তাঁর অভিনয় দক্ষতা নেই। তবু তিনি চান এবং সেসব করেও দেখান। এটি তাঁর ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যই একটি শ্রেণির কাছে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়। যাদের কিছু নেই; না অর্থ-বিত্ত-সম্পদ, না চেহারা-সুরত-কৌলীন্য। অথচ তাদের ভেতরেও আকাঙ্ক্ষা আছে সব পাওয়ার।

তারা হিরোর নাটক দেখেন, সিনেমা দেখেন, গান শোনেন। হিরো আলম যেন অপ্রাপ্তির আগুনে পোড়া অসংখ্য মানুষের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যারা তাঁকে নিজের করে ভাবে, আপনজন মনে করে। তথাকথিত আধুনিক-প্রগতিশীল-উচ্চমন্যরা ঠিক এ ব্যাপারটাই মানতে পারেন না। হিরো আলমের ঔদ্ধত্য ঠেকাতে তাঁকে তাচ্ছিল্য করা হয়। গান গাইলে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়।

এত কিছুর পরও হিরো আলমকে ঠেকানো যায় না। তিনি জনপ্রতিনিধি হতে চান। বারবার নির্বাচনে দাঁড়ান। সেখানেও তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। নিজের প্রার্থিতার বৈধতা পেতে তাঁকে হাইকোর্ট ঘুরে আসতে হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় নামলে তাঁর ওপর হামলা হয়। তবু তিনি পিছিয়ে যান না; মাঠ ছাড়েন না। দ্বিগুণ উৎসাহে আবার মাঠে নামেন; নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন।

নির্বাচনে হিরো আলম হারবেন, না জিতবেন– নির্ধারিত হবে আগামী ১৭ জুলাই। ফলাফল যা-ই হোক, হিরো আলমের ঔদ্ধত্যের বিজয়কে তাঁর নিন্দুকেরাও অস্বীকৃতি জানাতে দ্বিধান্বিত হবেন। নিজের সব অযোগ্যতা, অক্ষমতা, অদক্ষতা অকপটে স্বীকার করে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, তাঁকে হারিয়ে দিয়েও প্রতিপক্ষ প্রকৃত জয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকে যান।

পার্লামেন্টারিয়ান হওয়ার জন্য লড়ছেন হিরো আলম। হিরো আলম কি পার্লামেন্টারিয়ান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? তিনি একজন ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, এন্টারটেইনার। তিনি সিনেমা, নাটক, গান করেন। পার্লামেন্টারিয়ান হতে হলে তো এসব দিয়ে চলবে না। পার্লামেন্টারিয়ান হতে হলে পার্লামেন্টের প্রসিডিউর জানতে হয়। তার জন্য ঘটে খানিকটা বিদ্যা লাগে। সেটি তাঁর কতখানি আছে– প্রতিপক্ষ হয়তো এসব প্রশ্নই তুলবেন।

তা তারা তুলতেই পারেন। তোলাটাই যুক্তিসংগত। কিন্তু হিরো আলমের পক্ষ থেকে যদি প্রশ্ন তোলা হয়– এ পার্লামেন্টে পার্লামেন্টারিয়ান হওয়ার সেসব যোগ্যতা ক’জনের আছে, যা তাঁর বেলায় আশা করা হচ্ছে। তিনি তো একজন নাগরিক হিসেবে প্রার্থী হওয়ার সব যোগ্যতা পূরণ করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নেমেছেন। এখন তাঁকে শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার কথা বলাটাই হবে সবচেয়ে বড় ‘রুচিকর’ কাজ।

ঘটনাচক্রে যদি হিরো আলম পার্লামেন্টারিয়ান হয়ে যান, তাহলে পার্লামেন্টের মর্যাদা কতখানি খর্ব হবেম সে হিসাবও কষছেন অনেকে। অনেকেই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে নানান কথা বলছেন; প্রশ্ন তুলছেন। পার্লামেন্ট যেন একচেটিয়াভাবে উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল, অভিজাতদের। সেখানে মাটি কামড়ে বুকের জোরে লড়াই করে উঠে দাঁড়ানো কেবল নেটওয়ার্কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গ্রামের সিডি দোকানদারদের কোনো ঠাঁই নেই।

পার্লামেন্টারিয়ান হতে হলে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে; বনেদি ঘরানা থেকে আসতে হবে; সম্পদশালী হতে হবে; রাজনীতির কূটকৌশল সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে– এমন রীতি-রেওয়াজের জন্ম হলো কেমন করে? এসব ধারণার প্রচার-প্রসারই বা করছেন কারা? সেই মানুষদের জানা দরকার, যাদের কিছু নেই, যারা সব হতে চান। কারণ, তাদের এই কিছু না থাকার রহস্যটা জানা জরুরি।

এদেশে হিরো আলম সেসব মানুষের প্রতিনিধি, যারা পড়ে পড়ে মার খায়; মার খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়ায়; আবার মার খায়, কিন্তু মাঠ ছাড়ে না। হিরো আলম সেসব মার খাওয়া গরিব মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠছেন।

আরশাদ সিদ্দিকী: লেখক, গবেষক