বিচারের আগেই আপস হয়ে যায় গৃহকর্মী হত্যা-নির্যাতনের অধিকাংশ মামলা

‘গৃহশ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হন গৃহ মালিকের বাড়িতে। সেখানে তিনি একা থাকেন। তাই তিনি প্রতিবাদও করতে পারে না। আর মামলা হলে নিজে ছাড়া আর কোনো সাক্ষীও থাকে না’

২০১৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে আধমরা অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর ঢাকা মেডিকেলে চলে তার চিকিৎসা। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগে ঢাকা মেডিকেলে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে আদুরী/ফাইল ছবি/ঢাকা ট্রিবিউন

ডয়চে ভেলে

অর্থাভাবে হতদরিদ্র পরিবারের অনেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। সারাদেশে এমন গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। বাংলাদেশ ইনস্টিাটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে সারাদেশে ১,৫৬০ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, আহত, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন ৫৭৮ জন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, গত তিন বছরে সারাদেশে ৩৬ জন গৃহকর্মী তাদের মালিকের বাসায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৯০% নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন।

সম্প্রতি ঢাকায় গৃহকর্মী প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু আবারও সামনে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে গৃহকর্মী নির্যাতন ও এর বিচার না হওয়ার বিষয়টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক নির্যাতনের ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়া হয়। এমনকি হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনায়ও আপসের মাধ্যমে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যান অভিযুক্তরা।

প্রীতি উরাং নিহত হওয়ার ঘটনায় অবশ্য দেশের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং তার স্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি আটতলা ভবন থেকে পড়ে প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু হয়। ঘটনার পরদিন প্রীতির বাবা লোকেশ ওরাং বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় দুইজনকে আসামি করা হয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত তিন বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে ৩৬ জন গৃহকর্মী তাদের গৃহমালিকের বাসায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৯০% নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন। এ সময়ে মোট নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। কিন্তু এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে অনেক কম ৬৯টি।

আসকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৪৫০ জন গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় প্রায় ২০০-এর মতো নির্যাতন ও অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ ইনস্টিাটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ সুলতান উদ্দিন খান। তিনি বলেন, “গৃহকর্মী নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বাস্তবে আরও বেশি। যে হিসেব আপনারা দেখেন, তা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। অনেক ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে আসে না। আর অনেক ঘটনায়ই মামলা হয় না।”

বিলস-এর এক জরিপে অংশ নেওয়া ২৮৭ জন গৃহশ্রমিকের ৫০% জানিয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিলস-এর তথ্য বলছে, সারাদেশে মোট গৃহশ্রমিকদের ৯৫%-এর বেশি নারী। গৃহকর্তার কাছে ৫০% গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হন। যাদের অর্ধেক শিশু।

গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী আবুল হোসেন বলেন, “গৃহশ্রমিক নির্যাতন ও নিহত হওয়ার ব্যাপারে বিচারের অভিজ্ঞতা নির্মম। বিচার পাওয়ার নজির তেমন নেই বললেই চলে। যে ঘটনাগুলোতে মামলা হয়, সেখানে এজাহার খুবই দুর্বল থাকে। কারণ মালিক প্রভাবশালী থাকেন গৃহশ্রমিকদের তুলনায়। তারা সহজেই পুলিশকে প্রভাবিত করতে পারেন। ফলে মামলা ওখানেই অনেকটা শেষ হয়ে যায়। আর বিচারের আগেই অর্থের বিনিময়ে বা চাপ প্রয়োগ করে আপস করে ফেলা হয়। ফলে আর বিচার হয় না।”

তিনি আরও বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা হলো, আমরা গত দুই-তিন বছরে নির্যাতনের শিকার ২০ থেকে ২৫ জন গৃহকর্মী ও তার পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়েছি। কিন্তু আইনি সহায়তা দেওয়ার পরও আমরা মামলায় বিচার পাইনি। কারণ শেষ পর্যন্ত মামলা চালানো যায়নি। আপস হয়ে গেছে।”

বাংলাদেশে হত্যা ও নির্যাতনের মতো অপরাধের মামলা আইনে আপসযোগ্য নয়। তারপরেও কীভাবে আপস হয়? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, “এটা আদালতের বাইরে করা হয়। এটার নানা কৌশল আছে। প্রথমত মামলার তদন্তে দেরি করা হয়। এরমধ্যে নিহত বা নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর পরিবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারা গরিব। তাই তাদের অর্থের প্রলোভনে ফেলা হয়। তখন তারা মামলার ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখান না। সাক্ষী দিতে যান না। তখন মামলা এমনিতেই খারিজ হয়ে যায়।”

আর সৈয়দ সুলতান উদ্দিন খান বলেন, “কেউ যদি মামলা লড়তেও চান, তাহলেও কোনো লাভ হয় না। কারণ তখন অন্য সাক্ষীদের প্রভাবিত করা হয়।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী সারাদেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী আছেন। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ নারী। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন শিশুর সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর। আর এর মধ্যে শতকরা ৮০% মেয়ে শিশু।

বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা করা হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু সেটা কোনো আইন নয়। তাই তাদের বেতন, কর্ম পরিবেশ, কর্ম ঘণ্টা, বয়স, নিয়োগ কোনো কিছুই আইনের আওতায় হয় না। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করারও কোনো অধিকার নেই।

“বাংলাদেশ কর্মজীবী নারী” নামের সংগঠনটিও গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। সংগঠনের সমন্বয়কারী নার্গিস আক্তার নীলা বলেন, “গৃহশ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হয় গৃহ মালিকের বাড়িতে। সেখানে সে একা থাকে। তাই সে নির্যাতনের প্রতিবাদও করতে পারে না। আর মামলা হলে তার পক্ষে সে নিজে ছাড়া আর কোনো সাক্ষীও থাকে না। ফলে এখানে নির্যাতন বেশি। যেমন পোশাক কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করেন। তাই তারা প্রতিবাদ করতে পারেন।”

আবুল হোসেন মনে করেন, “রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা না পেলে গৃহশ্রমিকদের বিচার পাওয়া খুবই কঠিন। তাই তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা এবং অন্যান্য প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।”

প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরের মধ্যে একটি মাত্র মামলায় বিচারের উদাহরণ আছে। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন করে ঢাকার পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী ও তার মাকে তখন গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে অভিযোগ প্রমাণ হলে ঘটনার চার বছর পর ২০১৭ সালে ১৮ জুলাই নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত।