এজেন্টের মাধ্যমে আলুর দাম বাড়ায় হিমাগার মালিকরা

| এস সায়েম টিপু |

বাজারে আলুর উচ্চমূল্যের পেছনে হিমাগার মালিকদের কারসাজি রয়েছে। বেশি মুনাফার আশায় এজেন্টের (ফড়িয়া) মাধ্যমে কৌশলে আলুর দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছেন তাঁরা। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি নিশ্চিত করতে সম্প্রতি হিমাগার পর্যায়ে বেচাকেনার বিষয়টি তদারক করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিকার বলছে, বগুড়াসহ কয়েক জায়গায় অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা এজেন্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, হিমাগার মালিক, কৃষক ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার পর কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর বিষয়টি জানা যায়।

আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ১৮ দফা সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকারি এই অধিদপ্তর। প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আলু উত্পাদনপ্রবণ অঞ্চল বগুড়া, রংপুর ও নীলফামারী সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁরা দেশের বিভিন্ন হিমাগারে আলুর মজুদ, সরবরাহ পরিস্থিতি, ক্রয়-বিক্রর রসিদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রসাশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে অভিযান চালান।

এতে তাঁরা জানতে পারেন, আলুর উত্পাদন ও সংরক্ষণে চলতি বছর প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ব্যয় ১৮ থেকে ২০ টাকা, যা হিমাগার পর্যায়ে ২২ টাকা হলেও ফড়িয়াদের লাভ থাকে। কিন্তু বর্তমানে হিমাগার থেকেই ৪০ টাকায় আলু বিক্রি করা হয়, যা খুচরায় ৫৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিমাগার মালিকদের প্রভাবে কৃষকরা বরাদ্দ করা কৃষিঋণ পাচ্ছেন না। উত্পাদন মৌসুমে তাঁরা কৃষকদের নামে বরাদ্দ কৃষিঋণ অনৈতিকভাবে ব্যাংক থেকে তুলে তাঁদের নিয়োগ করা এজেন্টদের দিচ্ছেন।

এজেন্টরা ওই অর্থ দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। এতে কারসাজির পথ তৈরি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে অ্যাপ ব্যবহার চালু, হিমাগারে পাকা রসিদ দেওয়াসহ ১৮ সুপারিশ করেছে ভোক্তা অধিকার।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে আলুর চাহিদা ৮০ লাখ টন। চলতি বছর উত্পন্ন হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দুই লাখ টন আলু আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আলু আমদানি শুরু হয়। গত বুধবার পর্যন্ত ১৫ হাজার টন আলু আমদানি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ আলু রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় বিহার থেকে আলু আসছে।

বাজারে আলুর সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ৭০ টাকা। সরকার এর আগে হিমাগারে ২৭ টাকা দর নির্ধারণ করে দেয়। তবে আলু আমদানির ফলে বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার সুপারিশ

আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাঠানো ১৮ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষিঋণপ্রাপ্তি সহজীকরণ এবং প্রকৃত কৃষকদের হাতে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষিঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা; হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কৃষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া; সরাসরি মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোয় কৃষকদের আলুসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য বিক্রিতে বাধা দূর করা; পরিবহনকালে চাঁদাবাজিসহ বস্তায় অতিরিক্ত ব্যয় দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া; বিক্রির সব পর্যায়ে পাকা রসিদ নিশ্চিত করা; খুচরা ও পাইকারি বাজারে মূল্যতালিকা প্রদর্শন নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, আমদানি করায় আলুর বাজারে প্রভাব পড়েছে। এই আমদানি অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের আগে বাজারে নতুন আলু আসবে না।

তিনি বলেন, সরকারের তথ্য অনুযায়ী বছরে আলুর চাহিদা ৮০ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ে তথ্য অনুসারে এক কোটি ১১ লাখ টন উত্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৭ লাখ টন আলুর ঘাটতি ছিল। তাহলে বাকি আলু কোথায় গেল?

জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোক্তার সরেজমিন পরিদর্শনে হিমাগারগুলোর কারসাজি বেরিয়ে এসেছে। এ সময় বেশ কয়েকটি হিমাগারের কর্তৃপক্ষকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এই চক্র ভাঙতে হবে। সরকারি নজরদারি বাড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। যারা এই কারসাজির সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।