DW ২৭ মার্চ ২০২৫ , ৭:৩৭:৪৬
গুজব : দেশের সীমানায় এবং সীমানা ছাড়িয়ে
গত কয়েকদিন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী সংক্রান্ত বেশ কিছু গুজব ডালপালা মেলেছে। শুরুটা জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট এবং তারপর আরো দুই নেতার পোস্ট থেকে। সেই গুজবগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি, এবি পার্টির নেতা ব্যারিস্টার ফুয়াদ গ্রেপ্তার এবং সেনা সদরে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক। সেনা সদরের কথিত একাধিক বৈঠকের আলোচ্য সূচিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান ও সেনাসদরে জরুরি বৈঠকের যে খবর প্রকাশ করেছে, মঙ্গলবার তার প্রতিবাদ জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) । সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ইন্ডিয়া টুডে আবারও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি রুটিন সভা সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২৫ মার্চ প্রকাশিত ‘প্রধান উপদেষ্টাড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জরুরি বৈঠক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সাংবাদিকতার অসদাচরণ এবং এক সময়ের স্বনামধন্য একটি সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যা তথ্যের প্রচারক হয়ে ওঠার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং ‘আসন্ন অভ্যুত্থানের’ দাবি সম্পূর্ণরূপে অসাদাচরণমূলক। এটা খুবই দুঃখজনক যে, ইন্ডিয়া টুডে যথাযথ অধ্যবসায় বা সাংবাদিকতার সততার প্রতি দায়িত্বশীল প্রতিশ্রুতি ছাড়াই চাঞ্চল্যকর বিবরণ প্রকাশ করে চলেছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানোর আরেকটি প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে।”
রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ-এর সিনিয়র ফ্যাক্ট চেকার তানভীর মাহতাব আবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ” প্রধান উপদেষ্টা যখনই দেশের বাইরে যান, তখনই তাকে ও বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয় বলে আমরা লক্ষ্য করছি। এবারও চীন সফরের আগে তাই দেখা যাচ্ছে।”
‘তিন মাসে ভারতীয় গণমাধ্যম ১৯টি আর বাংলাদেশি গণমাধ্যম ৩৩টি গুজব ছড়িয়েছে’
তিনি জানান, রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ-এর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (১৯ মার্চ পর্যন্ত) বাংলাদেশকে নিয়ে প্রায় ৮০০ গুজব ছড়িয়েছে। এসব গুজবের মধ্যে সরাসরি ভারতীয় গণমাধ্যম ১৯টি আর বাংলাদেশি গণমাধ্যম ৩৩টি গুজব ছড়িয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ৩৮টি গুজব শনাক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জড়িয়ে ৪৪টি গুজব ছড়িয়েছে। রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ-এর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে ভারত থেকে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়িয়েছে ৪৫টি। মোট সাম্প্রদায়িক গুজব শনাক্ত করা হয়েছে ৬৭টি।
রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ-এর সিনিয়র ফ্যাক্ট চেকার তানভীর মাহতাব আবীর উদাহরণ দিয়ে বলেন, “ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি যখন ভাঙা হয়, তখন সেখানে সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। আজকেই (মঙ্গলবার) দেখলাম, ভারতীয় একজন সাংবাদিক সেই ভিডিওকে তার এক্স হ্যান্ডেলে সাভার থেকে ঢাকায় সেনাবাহিনী মুভ করেছে বলে পোস্ট দিয়েছেন। আবার পাঁচ বছরের পুরনো করোনার সময়ের সেনাবাহিনীর টহলের একটি ছবিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে।”
তার কথা, ” এইসব গুজব ছাড়াতে পুরনো ভিডিও, ছবি, বক্তব্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।”
সেনাবাহিনীকে নিয়ে ব্যারিস্টার ফুয়াদের যে ভিডিওটি ছড়ানো হয়, সেটা ৫ আগস্টের বলে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছে তার দল এবি পার্টি। ফুয়াদকে আটকের যে খবর কোথাও কোথাও ছড়িয়েছে সেটাকেও ‘গুজব’ বলেছে তারা।
ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের ফ্যাক্ট চেকার সুরাজউদ্দিন মন্ডল বলেন, ” ভারতের একটি পক্ষ, কিছু মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে গুজব ছাড়াচ্ছে- এটা সত্য। তবে সবাই যে এটা করছে, তা নয়। এখানে অনেক দায়িত্বশীল মিডিয়া আছে, যারা খবর যাচাই না করে প্রকাশ করে না। আমরা ৫ আগস্টের পর থেকে এই গুজব ছড়ানোর প্রবণতা বেশি দেখছি। ছাত্র আন্দোলনের সময় গুজব হয়েছে। কিছু মূল ধারার গণমাধ্যমও এগুলো করছে।”
তার কথা, ” তারা এটা টিআরপি, লাইক, ক্লিক বা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য করছে, না কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা আছে- সেটা আমরা বলতে পারবো না। তবে তারা করছে, এটা আমরা দেখতে পারছি। আর বাংলাদেশের বিভিন্ন আইডি থেকেও নানা ভুয়া খবর ছড়ানো হয়। সেগুলো আবার যাচাই-বাছাই না করেই এখানকার (ভারতের) কিছু সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করে।”
‘গণমাধ্যমের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থা এর জন্য দায়ী’
বাংলাদেশে নতুন গঠিত রাজনৈতি দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন মনে করেন, ” বাংলাদেশে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তার বিপক্ষে শক্তি আছে। দেশের ভিতরে আছে, বাইরেও আছে। তারাই এই গুজবের সঙ্গে জড়িত। কারণ, তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা ক্ষমতা হারিয়েছে।”
তবে দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার জায়মা ইমলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি এখানে সম্পূর্ণভাবে আমাদের গণমাধ্যমের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থাকে দোষারোপ করবো। গুজব, ফেক নিউজ এবং ডিসইনফর্মেশন তখনই পাকাপোক্ত হয়, যখন গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য তথ্যসূত্রের প্রতি মানুষ বেশি ঝুঁকে।”
তার কথা, “গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এমন শোচনীয় যে, আমরা অনেক সময়েই দেখি কেউ কেউ নিউজ দেখিয়ে আমাদের সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা আসল ঘটনাটা ক ‘?’, অর্থাৎ, তারা ধরেই নেয় যে পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়নি প্রতিবেদনে। যুগ যুগ ধরে আমাদের গণমাধ্যম যেইরকম সেলফ-সেন্সরশিপের মধ্যে কাজ করেছে, তার পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারে নাই। এখনো কিছু কিছু বিষয় সাংবাদিকদের প্রশ্নাতীত। গণমাধ্যমের কাছে সবাই সমানভাবে দায়বদ্ধ নয়।”
‘দেখে মনে হচ্ছে খুবই অর্কেস্ট্রেটেড’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, ” বাংলাদেশকে নিয়ে যেটা হচ্ছে এটাকে আমি প্রোপাগান্ডা মনে করি। এটাকে আমি অন্য কোনো নামে ডাকতে রাজি নই। এটা পুরনো, ক্লাসিক্যাল প্রোপাগান্ডা। বাংলাদেশে যে পরিবর্তন হয়েছে, এই পরিবর্তনটা যারা পছন্দ করেন না, তারা এই প্রোপাগান্ডার সঙ্গে জড়িত।”
“এটা একটা সিস্টেমেটিক প্রোপাগান্ডা, বহুজাতিক, বহুরাষ্ট্রিক, নানান জায়গা থেকে পরিচালিত হচ্ছে এবং দেখতে মনে হচ্ছে, খুবই অর্কেস্ট্রেটেড। এটাকে কাউন্টার প্রোপাগান্ডা দিয়ে ডিফিট করতে হয়। আরেকটা হতে পারে, আমরা আমাদের ইতিবাচক কাজগুলো তুলে ধরতে পারি,” বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হাসনাত আব্দুল্লাহসহ জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা সেনা সদরে বৈঠক নিয়ে ফেসবুকে ভিন্ন ভিন্ন যে পোস্ট দিয়েছেন তাতে হাসনাত ও সারজিসের মূল কথায় পার্থক্য নাই। কথাটা হলো, সেনাপ্রধান নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দেখতে চান। আর নতুন এই দলটি কোনো রেজিমেন্টেড পার্টি নয় যে, শুধু একজনই পার্টির কথা তুলে ধরেন। তাছাড়া, পার্টিতে সবারই প্রকাশ্যে কথা বলার স্বাধীনতা থাকা দরকার।”