সামিয়া রহমান প্রিমা,  ঢাকা টাইমস

বাংলাদেশ ঘিরে পরাশক্তিধর দেশগুলোর আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে সবশেষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচে জড়িয়ে পড়েছে ঢাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই পরাশক্তিধর দেশগুলোর পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পরাশক্তি দেশগুলোর সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে যারা বিজয়ী আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উচ্চতায় পৌঁছবে। যারা বিরোধিতা করছে, তাদের সঙ্গে টানাপড়েন বাড়তে পারে। কেননা, নির্বাচনপরবর্তী এই বিরোধিতা সহজভাবে দেখছে না বিজয়ী আওয়ামী লীগও।

মোটাদাগে, নতুন সরকারের কূটনীতিতে থাকছে নতুন হিসাব-নিকাশ, নতুন সমীকরণ। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সব দেশই সম্পর্ক বা অংশিদারত্ব জোরদারের কথাই বলে থাকে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে ভোটের আগে থেকেই শক্তিধর দেশগুলো পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ছিল। ক্ষমতাধর দেশগুলোর এক প্রান্তে ভারত, চীন ও রাশিয়া। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ২৭টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ভোটের পরেও তাদের অবস্থান একই রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় একের পর এক আসছে ভোটপরবর্তী পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া।

টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগের বিজয়ে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ৮ জানুয়ারি টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা, চীন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সজান্ডার মন্তিতস্কিসহ অনেকেই। নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ইউকে রাষ্ট্রদূত সারাহ কুকসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের গণভবনে দেখা যায়নি। তবে নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইইউ ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক সংকটকে সামনে এনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নির্বাচনি সহিংসতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন হয়নি উল্লেখ করে হতাশা ব্যক্ত করেছে। ভোটে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করারও আহ্বান পশ্চিমা দেশগুলোর।

তবে পশ্চিমাদের নির্বাচনপরবর্তী এসব বিবৃতি আপাতদৃষ্টে আমলে নিচ্ছে না সরকার। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন ও বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ। মার্কিন বা পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন ‘এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।’

অবশ্য এমন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিধরদের যে দখলকেন্দ্রিক অবস্থানটা দেখা যাচ্ছিল সেটাই আমরা নিশ্চিত করলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্য আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন নিয়ে তো বিদেশিরা গত একবছর ধরেই টানা কথা বলছে, এখানে দুটি পক্ষ আছে। পশ্চিমা দেশগুলোর বিবৃতিতে জনগণের আকাঙ্খা ও গণতন্ত্রের ঘাটতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বিবৃতিতে বলে নাই যে এই নির্বাচন পুনরায় হোক। বরং এটাও বলছে যে, বাংলাদেশ তথা এই সরকারের সঙ্গে পশ্চিমারা তাদের কাজ চালিয়ে যবে।’

তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন, পরাশক্তিধরদের সঙ্গে আমরা (বাংলাদেশ) যে দরকষাকষি করতে পারতাম বা তাদের বলয়ে যে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারতাম, এখন তা না হয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও উস্কে দেয়ার মতো পরিস্থিতি বা সূত্রপাত ঘটতে যাচ্ছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর প্রথমবারের মতো ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতি ঘোষণা করে বলা হয়- এর আওতায় রয়েছে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী ও বিচারবিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা। বলা হয়, যারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বাধা দেবে তারা ও তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

এই ঘোষণার ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কেন্দ্র করে মার্কিনীদের অসন্তোষ স্পষ্ট। তবে নির্বাচনপরবর্তী বিবৃতিতে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত নেই। অর্থাৎ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি উল্লেখ করে আগামীতে কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসীন দেশটি, এ নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা।

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে টানাপড়েন হলে বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ জানান, মার্কিনীদের থেকে বাংলাদেশ অনেক তুলা আমদানি করে, অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। তাই শুধু যে বাংলাদেশ ক্ষতির মুখে পড়বে তা না, তাদেরও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

তবে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বের যে স্বার্থ- সেখানে নতুন হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশ প্রবেশ করল। সেটা নিষেধাজ্ঞা হোক বা না হোক এই বলয়ে এদের যে লড়াই সে লড়াইয়ের অংশে পরিণত হলো বাংলাদেশ।’