নৌকার টিকিটপ্রত্যাশীদের অনেকে ‘অরাজনীতিক’

|মাহফুজ সাদি|

চার দিনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩৩৬২টি যার অনেকগুলোই কিনেছেন অরাজনীতিক ব্যক্তিরা। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ করলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ৩০০ আসনের বিপরীতে শনি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩৩৬২টি। দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, কর্মী-সমর্থক বেষ্টিত হয়ে, ব্যানার-প্লাকার্ড নিয়ে, মিছিল আর স্লোগান দিয়ে ফরম নিতে দেখা যায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের।

দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন এমন নেতাকর্মীরা যেমন ফরম কিনেছেন, পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছেন অন্য পেশা থেকে আসা ব্যক্তি। সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকলেও তারা জনপ্রতিনিধি হতে নৌকার টিকিট চান। এই তালিকায় আছেন সরকারের সাবেক আমলা, পুলিশ, সামরিক কর্মকর্তা, বিনোদন তারকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাংবাদিক, ক্রিকেটার, ফুটবলারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এবার একাধিক আসনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের সংখ্যাও কম নয়।

মনোনয়ন ফরম সংশ্লিষ্ট তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাবেক আমলাদের মধ্যে জামালপুর-৫ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম তাকে এরইমধ্যে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব মোহাম্মদ সাদিক, খুলনা-১ আসন থেকে সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়, ভোলা-৪ আসন থেকে সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন, নওগাঁ-৩ আসন থেকে সাবেক সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, চাঁদপুর-১ আসন থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব গোলাম হোসেন, চাঁদপুর-৫ আসন থেকে শাহ কামাল, বরগুনা-১ আসনে মিহির কান্তি মজুমদার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাছিমও আছেন এই তালিকায়।

এছাড়া বর্তমানে সংসদ সদস্য থাকা সাবেক আমলা মহিউদ্দিন খান আলমগীর, আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সাজ্জাদুল হাসান, মঞ্জুর হোসেন এবং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ কয়েকজন এবারও মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন কিশোরগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ, শরীয়তপুর-১ আসনে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, বরিশাল-৫ আসনে মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়া মাহবুব উদ্দিন (এসপি মাহবুব), কিশোরগঞ্জ-২ আসনে সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ, সাতক্ষীরা-৪ আসনে সাবেক সিনিয়র এএসপি শেখ আতাউর রহমান এবং সাবেক এসপি হাবিবুর রহমান।

সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে নৌকার মনোনয়ন ফর সংগ্রহ করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবির) সাবেক ডিজি আবুল হোসেন পটুয়াখালী-৩ থেকে। বর্তমান সংসদে থাকা পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, মুহাম্মদ ফারুক খান, নাসির উদ্দিন, এ বি তাজুল ইসলাম, সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, টাঙ্গাইল-৩ আসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান, রাজবাড়ী-২ আসনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান, ময়মনসিংহ-৪ ও ৯ আসনে স্বাচিপের সাবেক মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ, সিলেট-৩ আসনে বিএমএ মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে দলের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু, পাবনা-৪ আসনে ডা. সাহেদ ইমরান প্রমুখ।

বিনোদন তারকাদের মধ্যে নীলফামারী-২ আসনে অভিনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, মানিকগঞ্জ-২ আসনে সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি, ঝিনাইদহ-১ আসনে সিমলা, ফেনী-৩ আসনে অভিনেত্রী শমী কায়সার, বরিশাল-৩ আসনে নায়ক মাসুদ পারভেজ রুবেল, ঢাকা-১০ আসনে অভিনেতা ড্যানি সিডাক, ঢাকা-১৭ ও টাঙ্গাইল-১ আসনে অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান, পাবনা-৫ আসনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছেলে, প্রযোজক ও অভিনেতা আরশাদ আদনান রনি, বাগেরহাট-৩ আসনে চিত্রনায়ক শাকিল খান এবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

চার দিনই উপচেপড়া ভীড় ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা নড়াইল-২ আসন থেকে; সাকিব আল হাসান ঢাকা-১০, মাগুরা-১ ও ২ আসন থেকে, নাঈমুর রহমান দুর্জয় মানিকগঞ্জ-১ থেকে এবং ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় নেত্রকোনা-১ আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ফেনী-২ আসন থেকে, সাংকাদিক নঈম নিজাম কুমিল্লা-১০ আসন থেকে এবং সাংবাদিক সোহেল সানি বরিশাল-২ থেকে নৌকার মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এছাড়া এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন অ্যাডভোকেট রয়েছেন বলে জানা গেছে।

২০১৮ সালের চেয়ে ফরম কম বিক্রি হলেও এবার আয় বেশি হয়েছে আওয়ামী লীগের।

একই পরিবারের একাধিক সদস্যও ফরম সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা-৭ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাজী মো. সেলিম ও তার দুই ছেলে সোলায়মান সেলিম ও ইরফান সেলিম; গাজীপুর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলী টুসি ও ছেলে জামিল হাসান দুর্জয়; পাবনা-৪ আসন থেকে সাবেক ভূমিমন্ত্রীয় প্রয়াত শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ভাই-বোন, ভগ্নিপতিসহ পরিবারের ৬ জন।

ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক পারভীন হক সিকদার ঢাকা-১০ ও শরীয়তপুর-১,২ ও ৩ আসনে, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে এম জসিম উদ্দিন ঢাকা-১৭ আসনে, তার ভাই মোরশেদ আলম নোয়াখালী-২ আসনে মনোনয়ন ফরম তুলেছেন।

এছাড়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদিন নাছিম পাঁচটি আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। আসনগুলো হলো— ঢাকা-৬,৮ ও ১৪ এবং মাদারীপুর-২ ও ৩। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদে মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি ছিলেন নাছিম।

সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, কম সিলেটে

চার দিনে ৩ হাজার ৩৬২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা আয় করেছে আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদে ৪ হাজার ২৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। আর আয় হয় ১২ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

একই ব্যক্তি যেমন একাধিক আসনের জন্য মনোনয়র ফরম কিনেছেন, তেমনি একই পরিবারের একাধিক লোকও ফরম নিয়েছেন। 

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। প্রতি আসনে গড় ১১ জনের বেশি প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আট বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকায় ৭৩০টি ফরম বিক্রি হয়েছে। ঢাকা বিভাগে সংসদীয় আসন ৭০টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ১০ জনের বেশি প্রত্যাশী। চট্টগ্রাম বিভাগের আসন ৫৮টি। বিক্রি হয়েছে ৬৫৯টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ১১ জনের বেশি প্রত্যাশী। খুলনা বিভাগের আসন ৩৬টি। বিক্রি হয়েছে ৪১৬টি। প্রতি আসনের বিপরীতে প্রায় ১২ জন। রাজশাহী বিভাগের আসন ৩৯টি। বিক্রি হয়েছে ৪০৯টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ১০ জনের বেশি প্রত্যাশী।

রংপুর বিভাগের আসন ৩৩ টি। বিক্রি হয়েছে ৩০২টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ৯ জনের বেশি প্রত্যাশী। ময়মসিংহ বিভাগের আসন ২৪টি। বিক্রি হয়েছে ২৯৫টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ১২ জনের বেশি প্রত্যাশী। বরিশাল বিভাগের আসন ২১টি। বিক্রি হয়েছে ২৫৮টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ১২ জনের বেশি প্রত্যাশী। সিলেট বিভাগের আসন ১৯টি। বিক্রি হয়েছে ১৭২টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ৯ জনের বেশি প্রত্যাশী।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গত দুই নির্বাচনের কারণে অনেকের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নৌকা টিকিট পেলেই সংসদ সদস্য হওয়া অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই রাজনীতির বাইরের অনেকেই এখন বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চাইছেন। তার ফলশ্রুতিতে এবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অরাজনীতিক বা অন্য পেশার মানুষ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এ সভা থেকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া।

এবার ২০১৮ সালের তুলনায় কম ফরম বিক্রি হয়েছে। তবে আয় হয়েছে বেশি। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের ৪ হাজার ২৩টি ফরম বিক্রি করে ১২ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় করেছিল। আগের চেয়ে ফরমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার আয় বেড়েছে। ২০১৮ সালে ফরমের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা। এবার সেটা ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন