এফ এম আবদুর রহমান মাসুম ১০ মার্চ ২০২৫ , ৩:৩৮:১১
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন সামনের সারিতে। ওই সময় ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে পুলিশ গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও আবু সাঈদ একাই অবিচল দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় তার।
পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও আবু সাঈদের মৃত্যুকে ওই সময় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়, পুলিশের গুলির পর আবু সাঈদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার মৃত্যুর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলে। ওই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালীন সরকারের প্রশাসন, শিক্ষক ও চিকিৎসক।
ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগও জমা পড়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা আবু সাঈদ হত্যার আসামি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষক ও ছাত্রলীগের নেতাসহ ২০ জনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। গত ৫ মার্চ এনবিআর চেয়ারম্যানকে সংস্থার সমন্বয়ক মুহম্মদ শহীদুল্যাহ চৌধুরী পিপিএম সই করা চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২৪-এর গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণী চেয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সাবেক সরকারের আস্থাভাজন, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত ২০ জনের নামে-বেনামে ক্রয় করা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণ প্রয়োজন। জরুরিভিত্তিতে তদন্ত সংস্থাকে সম্পদের বিবরণ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার অভিযোগ রেজিস্টারের ক্রমিক নম্বর ১৫৬ এবং আইসিটি বিডি মিস কেইস নম্বর ১২/২০২৫ এর রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক সাত কর্মকর্তা। তারা হলেন— রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ নূর আলম পাটোয়ারী, রংপুর মেট্রোপলিটনের কোতোয়ালি জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরান হোসেন ও রংপুর মেট্রোপলিটনের তাজহাট থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ রবিউল ইসলাম।
এ ছাড়া তালিকায় আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। তারা হলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ, সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর শরীফুল ইসলাম, সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান ও লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডল।
রংপুর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহাম্মেদ সাদাত ও রংপুর কোতোয়ালি থানার চিকিৎসক সারোয়াত হোসেন ওরফে চন্দনের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সম্পদের বিবরণীও চাওয়া হয়েছে সেখানে। তারা হলেন— বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান শামীম, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার দাস ওরফে টগর, তথ্য সম্পাদক বাবুল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এমরান চৌধুরী আকাশ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান মাসুদ। তালিকায় থাকা সবাই আবু সাঈদসহ অভ্যুত্থানে নিহতদের হত্যার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল থেকে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণ চাওয়া হয়েছে। আমরা আইন ও বিধি অনুযায়ী সকল নথিপত্র সরবরাহ করব। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এনবিআরের যা যা করণীয় সবই করা হবে।’
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৮ আগস্ট রংপুরের আদালতে হত্যা মামলা করেন আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী। মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি আবদুল বাতেন, রংপুর মহানগর পুলিশের তৎকালীন কমিশনার মনিরুজ্জামানসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামিম মাহফুজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান মণ্ডল, গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান।
যদিও পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ সাতজনের নাম মামলায় নথিভুক্ত করার জন্য সম্পূরক এজাহার দায়ের করেন তিনি। আদালতের আদেশে তাদেরও ওই মামলায় নামীয় এজহারভুক্ত আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গত ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা করে।