ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
৪৭ শতাংশ মামলার বাদী পুলিশ ও ক্ষমতাসীনেরা
চার বছর আগে পাস হয় এই আইন। সবচেয়ে বেশি অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে সাংবাদিক ও বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে।

|আহমদুল হাসান|
দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরা। একজন অতিথি সেই অনুষ্ঠানে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। এ অভিযোগে খাদিজা ও অতিথির বিরুদ্ধে ঢাকার নিউমার্কেট থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন পুলিশের এক উপপরিদর্শক।

খাদিজার বিরুদ্ধে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা, গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি এবং সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২৪ দিন ধরে কারাগারে আছেন খাদিজা। এই সময়ে তিনবার আবেদন করেও জামিন পাননি তিনি।

খাদিজার বোন মনিরা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় খাদিজার বয়স ছিল ১৭ বছর। কেবল একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি হয়েছেন তাঁর বোন। তিনি সেখানে নিজের কোনো মত দেননি।

সেই মামলায় পুলিশ খাদিজা ও ওই অতিথির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এরপর গত ২৬ আগস্ট মিরপুর থেকে তাঁর বোনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে খাদিজার বিরুদ্ধে এই মামলা করে। মামলার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে খাদিজার ভবিষ্যৎ। তাঁদের পরিবারকেও যেতে হচ্ছে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

এই আইনের কারণে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ কারণে আইনটি রাখার যৌক্তিকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই।
নূর খান, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করছেন বলে অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আইনটি প্রণয়ন হওয়ার পর গত চার বছরে এই আইনে ১ হাজার ৭০০–এর বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ৩৫৩টি মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।

এসব তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৬৫টি মামলার বাদী পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। অর্থাৎ মোট মামলার ৪৭ শতাংশই করেছেন প্রভাবশালীরা। এই আইনে ৩৬ শতাংশ মামলা হয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও অপপ্রচারের অভিযোগে।

কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো প্রশাসনিক কারণে এবং কখনো সাংবাদিকদের হেনস্তা করার জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক নেতা
ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালের এই দিনে (১৯ সেপ্টেম্বর) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সরকার। শুরু থেকেই এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মতো এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে। এখন তাঁরা বলছেন, তাঁদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করার পাশাপাশি ভিন্নমত দমনে এই আইন ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।

চলতি বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশের মাশুল গুনতে হয়েছে সাংবাদিকদের। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কারাগার থেকে মুক্তি পান কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর। ফটোসাংবাদিক আবুল কালাম, খুলনা গেজেট ও দৈনিক লোকসমাজ-এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু সংবাদপত্র নয়, বাংলাদেশে জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চা করতে গিয়েও বাধার মুখে পড়ছেন অনেকে। বাউলশিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে এই আইনের উত্থাপক ছিলেন তৎকালীন আইসিটি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ অপপ্রয়োগ হয়েছে ব্যক্তি পর্যায়ে। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে হয়রানি বা হেয় করতেই সেটি প্রয়োগ করা হয়েছে।

তবে কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর মর্মার্থ বুঝতে না পেরে বা তদন্ত না করে অথবা যেকোনো কারণেই হোক কিছু মামলায় আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে। অপরাধীর শাস্তি হওয়ার কথা থাকলেও নিরীহ ব্যক্তি ভুক্তভোগী হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রের ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন যতটুকু আছে, এই আইন না থাকলে এর ‘ছিটেফোঁটাও’ থাকত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সরকারি দলের লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন। এমনকি সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করেও অনেকেই মামলার আসামি হয়েছেন।
নূর খান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন।

মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯ বলছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১৪টি মামলার তথ্য-উপাত্ত তারা সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৯৩টি। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ মামলাই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় ৯৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৯ শতাংশ আসামিই হচ্ছেন সাংবাদিক।

এমনই একজন ভুক্তভোগী ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের ১১ মার্চ ঢাকার চকবাজার থেকে নিখোঁজের ৫৩ দিন পর যশোরের বেনাপোলের সীমান্তে তাঁর খোঁজ মেলে। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১০ মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালতে রিট করে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জামিন পান তিনি। তিনটি মামলার বাদীর মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং দুজন মহিলা লীগের নেত্রী।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার: গণতন্ত্র মঞ্চ
শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখনো গুম হয়ে যাওয়ার ভয় পান। ভয়ে কেউ তাঁকে চাকরি দিতে চায় না।

আর্টিকেল-১৯–এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল প্রথম আলোকে বলেন, ভয় দেখাতে এই আইন করা হয়েছে, বিশেষ করে সাংবাদিকদের জন্য। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যেন কোনো কথা না বলে।

এই আইনের ভয়াবহ অপপ্রয়োগ হচ্ছে জানিয়ে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো প্রশাসনিক কারণে এবং কখনো সাংবাদিকদের হেনস্তা করার জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। যতজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে, একটিও যথার্থ সাংবাদিকতার কারণে প্রয়োগ করা হয়নি। শুধু প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়েছে।

বিরোধী দমনে আইনের প্রয়োগ
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন। সেই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

গত জুলাইয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল মগনামা ইউপি ভবনে। এ কারণে আওয়ামী লীগ নেতা ও মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুচ চৌধুরীকেও সহযোগিতার অভিযোগের আসামি করা হয়। এই মামলার বাদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

মামলার আসামি আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুচ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ওই মামলাটি যেদিন হয়, তার ছয় দিন পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ছিল। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে আবুল কাশেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম আমি। বিএনপির অনুষ্ঠানকে অজুহাত করে তাঁকে (ইউনুচ) সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে রাখতে আবুল কাশেম এই মামলা করেন।

মামলার কারণে দুঃসহ জীবন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় ভুক্তভোগী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের সমালোচনা করার অভিযোগে ২০২০ সালের ১৭ জুন তাঁর বিরুদ্ধে রাজশাহীর মতিহার থানায় মামলা করেন আওয়ামীপন্থী এক আইনজীবী।

ওই দিন রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭১ দিন কারাভোগের পর জামিন পান তিনি। ২০২১ সালের নভেম্বরে এই মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেন উচ্চ আদালত।

কাজী জাহিদুর প্রথম আলোকে বলেন, এই মিথ্যা মামলার কারণে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সামাজিক মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সব মিলে একটি দুঃসহ সময়ের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। কারণ, কাউকে তো আর বোঝানো যেত না এটা মিথ্যা মামলা।

সুশাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ এক গবেষণায় দেখিয়েছে, সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ওই আইনের ৩৯ ধারায়। এই ধারাটি মূলত মানহানির তথ্য প্রচারবিষয়ক। অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বিবেচনায় এই আইনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ২৫ ধারা। এই ধারা হচ্ছে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য–উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী জাহিদুরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার একটি ধারা ছিল ২৫।

ধর্মীয় বিষয়ে মন্তব্য করেও অনেকেই এই মামলার আসামি হচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই আইনের ১০ শতাংশ মামলা হয় ধর্মীয় বিষয়ে মন্তব্য করার কারণে। তবে অনেক সময় ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে ধর্মীয় উসকানি ছড়িয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার অভিযোগও রয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সরকারি দলের লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন। এমনকি সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করেও অনেকেই মামলার আসামি হয়েছেন।

সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আইনজীবীসহ সব পেশার মানুষ এই আইনের মামলায় ভুক্তভোগী হয়েছেন। এ আইনের কারণে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ কারণে আইনটি রাখার যৌক্তিকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই।

স্বত্ব © ২০২২ প্রথম আলো