২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৬:১৬:৫৭
সাইফুল সামিন | প্রথম আলো
কৈশোরে বাবাকে হারান। আসে আর্থিক টান। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সংসার চালানোসহ নানা দায়িত্ব কাঁধে চাপে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে পেশাদার ভূমি জরিপকারী (সার্ভেয়ার) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বছর কয়েকের মাথায় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে সুনাম কুড়ান। একপর্যায়ে সামরিক পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে নাম লেখান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিন বিপ্লবী এই যুদ্ধে আমেরিকান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। যুদ্ধজয়ের পর স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সংবিধান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
নতুন সংবিধানের অধীন স্বাধীন দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। পরপর দুই মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করেন। দেশ গড়তে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে তিনি এমন সব পদক্ষেপ নেন, যা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনক।
জর্জ ওয়াশিংটনের জন্ম ১৭৩২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমেরিকার ভার্জিনিয়ার ওয়েস্টমোরল্যান্ড কাউন্টিতে।
বাবা অগাস্টিন ওয়াশিংটন সিনিয়র, মা মেরি বল ওয়াশিংটন। এই দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম। তাঁর চার সৎভাই–বোন ছিলেন। বয়সে তাঁরা সবাই ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটনের চেয়ে বড়। তাঁরা (চার সৎভাই–বোন) ছিলেন অগাস্টিন ওয়াশিংটন সিনিয়রের প্রথম স্ত্রী জেন বাটলারের ঘরের সন্তান। জেন বাটলার ১৭২৯ সালে মারা গেলে মেরি বলকে বিয়ে করেন অগাস্টিন ওয়াশিংটন সিনিয়র।
জর্জ ওয়াশিংটনের বয়স যখন ১১ বছর, তখন তাঁর বাবা অগাস্টিন ওয়াশিংটন সিনিয়র মারা যান। তাঁর সম্পত্তির অধিকাংশ চলে যায় জর্জ ওয়াশিংটনের প্রাপ্তবয়স্ক সৎভাইদের কাছে।
কিশোর জর্জ ওয়াশিংটন নিজেদের যে বাগান ছিল, তা দেখভালে তাঁর মাকে সাহায্য করতেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি কিশোর বয়সেই কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষতার গুরুত্ব সম্পর্কে দীক্ষা অর্জন করেন।
অর্থসংকটের পাশাপাশি পারিবারিক বাগান দেখভালের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৫ বছর বয়সে জর্জ ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষার ইতি ঘটে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তাঁর হয়নি।
১৮ শতকের আমেরিকায় ভূমি জরিপ ছিল একটি সম্মানজনক পেশা। সামাজিক ও আর্থিক—উভয় ধরনের অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ এই পেশায় ছিল। ১৭৪৯ সালে একজন পেশাদার ভূমি জরিপকারী হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনের কর্মজীবন শুরু হয়। অবশ্য ১৭৫২ সালের পর তিনি আর পেশাদারভাবে ভূমি জরিপের কাজ করেননি।
সামরিক বাহিনীতে কাজ করার আগ্রহ আগে থেকেই ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের। তিনি ১৭৫২ সালে ভার্জিনিয়া মিলিশিয়ায় যোগ দেন। ইংরেজ মিলিশিয়া–ব্যবস্থার একটি অংশ ছিল ভার্জিনিয়া মিলিশিয়া।
১৭৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্জ ওয়াশিংটন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন। তাঁকে নবগঠিত ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ করা হয়। ১৭৫৪ সালের মে মাসে ‘ফরাসি ও ভারতীয় যুদ্ধ’ শুরু হয়, যা চলে ১৭৬৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে অংশ নেন জর্জ ওয়াশিংটন।
যুদ্ধে নেতৃত্বের দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৭৫৫ সালে জর্জ ওয়াশিংটন কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। তাঁকে ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ১৭৫৮ সালে তিনি বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
সামরিক বাহিনীতে কাজ করে জর্জ ওয়াশিংটনের আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশদের সামরিক কৌশল রপ্ত করেন। তাঁর এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে তাঁকে এক সফল বিপ্লবের সামরিক নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করে।
রেজিমেন্ট ছাড়ার পর জর্জ ওয়াশিংটন ভার্জিনিয়ার মাউন্ট ভার্ননে তাঁর বাড়িতে ফিরে যান। তিনি আবার বাগান ও খামারের কাজ শুরু করেন।
১৭৫৮ সালে ঔপনিবেশিক ভার্জিনিয়া আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি প্রায় দেড় দশক এই আইনসভার সদস্য ছিলেন।
জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৫৯ সালে এক ধনী বাগানমালিকের বিধবা স্ত্রী মার্থা ড্যানড্রিজ কাস্টিসকে বিয়ে করেন। একপর্যায়ে জর্জ ওয়াশিংটন ভার্জিনিয়ার অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে জর্জ ওয়াশিংটন ভার্জিনিয়া আইনসভার অধিবেশনে খুব কমই যোগ দিতেন। আর অধিবেশনে যোগ দিলেও তিনি খুব কমই কথা বলতেন।
তবে ১৮ শতকের ষাটের দশকের শুরুতে জর্জ ওয়াশিংটন রাজনৈতিকভাবে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি আমেরিকান উপনিবেশগুলোয় (১৩টি) ব্রিটিশদের নানান অন্যায্য, নিপীড়নমূলক পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম ছিল রয়্যাল প্রোক্লেমেশন (১৭৬৩), স্ট্যাম্প অ্যাক্ট (১৭৬৫), টাউনশেন্ড অ্যাক্টস (১৭৬৬-৬৭), বোস্টন গণহত্যা (১৭৭০), ইনটলারেবল অ্যাক্টস (১৭৭৪)।
১৭৭৪ সালের আগস্টে প্রথম ভার্জিনিয়া কনভেনশনে যোগ দেন জর্জ ওয়াশিংটন। এই কনভেনশনে তিনি ফিলাডেলফিয়ার প্রথম কনটিনেন্টাল কংগ্রেসে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন।
একই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফিলাডেলফিয়ায় ১২টি আমেরিকান উপনিবেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রথম কনটিনেন্টাল কংগ্রেস হয়। এই কংগ্রেসে যোগ দেন জর্জ ওয়াশিংটন। কংগ্রেসে অধিকারের ঘোষণাপত্র (ডিক্লারেশন অব রাইটস) গৃহীত হয়।
১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ (স্বাধীনতাযুদ্ধ) শুরু হয়। ১৭৭৫ সালের ১৪ জুন ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় কনটিনেন্টাল কংগ্রেস ‘কনটিনেন্টাল আর্মি’ গঠনে ভোট দেয়। জর্জ ওয়াশিংটনকে এই আর্মির ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাঁকে এই পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় মূলত তাঁর অতীত সামরিক অভিজ্ঞতার কারণে। পরদিন কংগ্রেস তাঁকে সর্বসম্মতভাবে এই যুদ্ধে কনটিনেন্টাল সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নির্বাচন করে। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়।
প্রায় আট বছর যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়ে। আমেরিকানদের পক্ষ নিয়ে প্রথমে ফ্রান্স যুদ্ধে যুক্ত হয়। পরে স্পেন ও ডাচ প্রজাতন্ত্র আমেরিকানদের পক্ষ নেয়।
জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন কনটিনেন্টাল আর্মি ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ আর্মিকে পরাজিত করে। ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারিস চুক্তি (ট্রিটি অব প্যারিস) সই হয়। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ শেষ হয়। আমেরিকার স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন। স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র।
১৭৮৩ সালের নভেম্বরে জর্জ ওয়াশিংটন কনটিনেন্টাল আর্মি ভেঙে দেন। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তিনি কনটিনেন্টাল আর্মির ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একটি নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর এই পদক্ষেপ দেশ-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়।
স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা খুব করে অনুভব করছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতীয় সংবিধান একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন অঙ্গরাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।
কংগ্রেস ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় একটি সাংবিধানিক সম্মেলন (কনস্টিটিউশনাল কনভেনশন) করতে সম্মত হয়। এই সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি হয়। ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান স্বাক্ষরিত হয়। অনুমোদিত হয় ১৭৮৮ সালে। আর ১৭৮৯ সালে কার্যকর হয়।
নতুন সংবিধানের অধীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৭৮৯ সালে নির্বাচিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। ৬৯ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে তিনি সর্বসম্মতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি শপথ নেন।
মেয়াদ শেষে অবসরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের। কিন্তু উপদেষ্টাসহ রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের অনুরোধে, পরিস্থিতি বিবেচনায়, দেশের স্বার্থে তিনি শেষ পর্যন্ত আরেকবার নির্বাচনে লড়তে রাজি হন।
১৭৯২ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন সর্বসম্মতভাবে পুনর্নির্বাচিত হন। ১৭৯৩ সালের ৪ মার্চ তিনি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ১৭৯৭ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন।
জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর দুই মেয়াদকালে সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করেন। তিনি জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দেন। একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার (রিপাবলিকানিজম) প্রচলন ও চর্চার একজন অগ্রগণ্য রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ ডাকার ধারা তিনি চালু করেন। এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার রীতির প্রচলন তাঁর হাত ধরেই হয়।
জর্জ ওয়াশিংটন রাজনৈতিক দলাদলির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রেসিডেন্টের মেয়াদের পুরোটা সময় নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। দেশের বাইরের ঘটনাবলি, বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তাঁর নীতির কারণে মুক্তি ও জাতীয়তাবাদের একটি আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিকে দাসত্বের বিরোধিতা করেন। তাঁর অধীন থাকা দাসদের মুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৭৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ব্রিটানিকা, হোয়াইট হাউস ডট গভ, হোয়াইট হাউস হিস্টোরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন