আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস জানিয়েছিলেন, তারা প্রতিরাতে খাওয়ার পর থালাবাসন পরিষ্কার করেন। আবার রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগকারী ও বিলিয়নিয়ার চার্লস কোহেন মনে করেন, পেশাদার কাজের বাইরে ঘরের কাজ করা এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসে তার মনে।

বিশ্বের শীর্ষ বিলিয়নিয়ারদের অনেকেই কেন এখনও গৃহস্থালি কাজ করেন?

বিশ্বের শীর্ষ ধনী, বিলিয়নিয়ার এই কথাগুলো শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে রাজকীয় বাড়ি, ব্যক্তিগত বিমান এবং এমন আরো অনেক বিলাসিতা যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু এসব বিলিয়নিয়ারদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে তাদের জীবনযাপনের ধরন এতটাই সাধারণ যা আমাদের ধারণার বাইরে!

ফোর্বসের সাম্প্রতিক এক জরিপ অন্তত সেকথাই বলছে। বিশ্বের শীর্ষ ৬৫ ধনী ব্যক্তির বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তারা দেখেছে, প্রচন্ড ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও তাদের অনেকেই কোনো না কোনো গৃহস্থালি কাজ করেন। এসব বিলিয়নিয়ারদের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, তারা দৈনিক মুদি দোকানে যান কিংবা ময়লার বালতি বাইরে রাখেন। অন্যদিকে, এদের ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা রান্নাবান্না করেন এবং প্রিয় কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকেরও বেশি জানিয়েছেন, তারা ছেলেমেয়ে অথবা নাতি-পুতিদের সময় দেন।

তবে এসব ধনকুবেররা অবশ্যই নিজেদের সীমা মেনে চলেন। কারণ জরিপে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ নিয়মিত বাগানে কাজ করেন এবং লন্ড্রির কাজ করেন সবচেয়ে কম- মাত্র ৮ শতাংশ।

কিন্তু হাজারো কোটি টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও কেন বিলিয়নিয়াররা সাধারণ গৃহস্থালি কাজে সময় ব্যয় করেন, তার পেছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস যথাক্রমে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় ২ ও ৪ নম্বরে রয়েছেন। বেজোসের সম্পত্তির পরিমাণ ১৪৬.৮ বিলিয়ন ডলার এবং বিল গেটসের সম্পদের পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন ডলার। এই দুই বিলিয়নিয়ার আগেপরে জানিয়েছেন, তারা প্রতিরাতে খাওয়ার পর থালাবাসন পরিষ্কার করেন। এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে রেডইট কিউ-এ তে বিল গেটস বলেছিলেন, “অন্যরাও সাথে সাহায্য করে, কিন্তু আমি নিজের মতো করে এই কাজটা করতে পছন্দ করি।”

আবার রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগকারী চার্লস কোহেনের কাছে গৃহস্থালি কাজের গুরুত্ব অন্য রকম। ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের মালিক কোহেনের মালিকানায় আছে নিউইয়র্ক শহরের একাধিক হাই-এন্ড অফিস ভবন এবং সিনেমা থিয়েটার চেইন ল্যান্ডমার্ক থিয়েটারস। কোহেন জানিয়েছেন, পেশাদার কাজের বাইরে ঘরের কাজ করা এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসে তার মনে।

ফোন কলের মাধ্যমে কোহেন বলেন, “বিষয়টা খুব মজার যে আপনারা এখনই এই প্রসঙ্গ তুললেন, কারণ আমি মাত্রই কিছু স্প্রিংকলার ও বালব কিনে নিয়ে হোম ডিপো থেকে বাড়ি ফিরছি। আমি বাইরে ঘুরতে এবং নিজের খুশিমতো বিভিন্ন কাজ করতে পছন্দ করি।”

গতানুগতিক কাজ থেকে সপ্তাহান্তে একটু বিরতি নিতে গ্রোসারি শপিং (মুদিদ্রব্য কেনা) ও গ্রিলিং এর মতো কাজগুলো করে থাকেন এই রিয়েল এস্টেট মোগল। ওয়েস্টচেস্টারের শহরতলীর একটি বাড়িতে বেড়ে ওঠা কোহেন জানান, ছেলেবেলায় তাদের বাড়িতে একজন গৃহকর্মী ছিল। কিন্তু এখন তিনি এবং তার স্ত্রী বাড়ির বেশিরভাগ কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করেন, যাতে সন্তানদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারেন।

“বিষয়টা হচ্ছে- নিজে যেসব কাজ উপভোগ করেন সেগুলোই করা। এমন একটি লাইফস্টাইল তৈরি করা যা আপনার ব্যক্তিসত্ত্বাকে তুলে ধরবে এবং সন্তানদেরও এই পথ অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে”, বলেন কোহেন। তবে তার মানে এই না যে কোহেন পরিবার খুব মিতব্যয়ী জীবনযাপন করে। যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে ব্যক্তিগত স্ক্রিনিং রুমসহ ৩৯ একরের স্থাবর সম্পত্তি এবং ফ্রান্সে একটি আঙ্গুরের ক্ষেত রয়েছে তাদের।

স্বাস্থ্য-সেবা প্রতিষ্ঠান মেলালিউকা’র প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান এবং আইডাহো রাজ্যের শীর্ষ ধনী ফ্রাংক ভ্যান্ডারস্লুট জানান, গৃহস্থালি কাজ তার কাছে খুব আপন মনে হয় কারণ তিনি সেভাবেই বেড়ে উঠেছেন। রেল শ্রমিকের সন্তান ভ্যান্ডারস্লুট তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করেন- যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার আগে তাকে নিজেদের খামারে কাঠ কাটতে হতো এবং গরুর দুধ দোয়াতে হতো।

ভ্যান্ডারস্লুট বলেন, “লোকে ভাবে আপনার অনেক ব্যাংক-ব্যালেন্স আছে মানেই আপনি সবার চেয়ে ভিন্ন মানুষ। কিন্তু বিষয়টা তা নয়, অন্তত আমি সেভাবে চিন্তা করি না।” তিনি আরও জানান, তাদের ১৫ কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে তার স্ত্রী বেলিন্দা একজন গৃহকর্মী রেখেছেন। কিন্তু রান্নাবান্না ও লন্ড্রিসহ অধিকাংশ গৃহস্থালি কাজ তিনি ও তার স্ত্রীই করেন। শুধু তাই নয়, তারা তাদের নাতি-নাতনিদেরও গৃহস্থালি কাজ করার বিনিময়ে টাকা দেন।

“আমি মনে করি, অর্থবিত্ত বা সফলতা পদে পদে আপনার চরিত্রের পরীক্ষা নিবে, যা ব্যর্থতাও কোনোদিন নিতে পারবে না। আর এখানেই আপনাকে সচেতন হতে হবে। সফলতা যদি মানুষ হিসেবে আপনাকে বদলে ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে হবে আপনি জীবনের আসল অর্থই বুঝতে পারেননি”, বলেন ভ্যান্ডারস্লুট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো এক বিলিয়নিয়ার ফোর্বসকে জানিয়েছেন, তিনি ময়লার বালতি বাইরে রাখা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া- মাঝেমাঝে লন্ড্রির কাজসহ সব রকম গৃহস্থালি কাজই করেন। কারণ তিনি অন্যের কাছ থেকে সেবা নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।

তবে বিশ্বজুড়ে সব বিলিয়নিয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন এক নয়। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শীর্ষ ধনীরাই এসব গৃহস্থালি কাজ করেন না। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশ ধনী জানিয়েছেন যে তারা রান্নাবান্না করেন না, ৬২ শতাংশ জানিয়েছেন তারা ময়লার বালতি বাইরে রাখার কাজটি করেন না এবং লন্ড্রির কাজ করেন না ৯২ শতাংশ। আবার এসব কাজ না করার পেছনেও তাদের যুক্তি রয়েছে।

পাম বিচ-ভিত্তিক রিয়েল এস্টেট মোগল জেফ গ্রিনের ভাষ্যে, তিনি অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ, কিন্তু তার বাড়িতে গৃহস্থালি কাজ সামলানোর জন্য একাধিক কর্মী আছে। জেফ গ্রিন বলেন, “আমি এখানে লাখ লাখ ডলারের ব্যবসা চালাই। আমার ইতোমধ্যেই ভীষণ কাজের চাপ। তাই ঘরের যেসব কাজের জন্য আমি অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে পারি, সেখানে নিজের সময় দেওয়াকে আমি সমর্থন করি না।”

কিন্তু ব্যবসায়িক কাজের বাইরে যখনই সময় পান, তখন নিজের তিন সন্তানকে সময় দেন বলে জানান জেফ গ্রিন। তিনি সন্তানদের প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যান-নিয়ে আসেন। তার ভাষ্যে, “আমি ও আমার স্ত্রী সন্তানদের সাথে অনেক বেশি যুক্ত থাকতে চাই। কোনো এক কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে ডেডলাইন নিয়ে বাক্যব্যয় করার চেয়ে নিজের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

সূত্র: ফোর্বস /টিবিএস ডেস্ক