মামলায় ‘যথাযথ’ সাক্ষ্য না দিলে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা

|নুরুজ্জামান লাবু|

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়ার মামলাগুলোতে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি সাক্ষীর তালিকায় থাকেন পুলিশ সদস্যরাও। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবেও পুলিশ সদস্যদের আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হয়। কিন্তু আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়ার পর অনেক মামলায় পুলিশ সদস্যরা আর সাক্ষ্য দিতে চান না। অনেকেরই দূরবর্তী কোনও জায়গায় বদলি হওয়ার কারণে এ ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু যথাযথ সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলায় বিচার সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এজন্য সদর দফতর থেকে বারবারই পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। এতেও কাজ হয়নি। তাই এবার নতুন ব্যবস্থা। ধার্য তারিখে যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ সদস্য সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক মামলাগুলোর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে রাজনৈতিক মামলাগুলোর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় পুলিশ সাক্ষীদের অনেকেই ‘অহেতুক ঝামেলায়’ জড়ানোয় অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এজন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে চিঠি দিয়ে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এনআরবি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক জেসমিন বেগম স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অনুপস্থিত পুলিশ সাক্ষী ও যথাযথভাবে সাক্ষ্য প্রদান করেনি, এ ধরনের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় বলা হয়, সারা দেশে বিচার চলমান থাকা মামলাগুলোয় পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য প্রদানের দিন ধার্য থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় পুলিশ সাক্ষীরা মামলার ধার্য তারিখে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় বিচার চলমান মামলাগুলোতে যথাসময়ে পুলিশ সাক্ষী হাজির নিশ্চিতকরণ, বিনা কারণে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুলিশ সাক্ষী যে ইউনিটে কর্মরত সে ইউনিট যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে সাক্ষ্য প্রদানের ধার্য তারিখ অবগত করে সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য ছাড়পত্র নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া ধার্য তারিখে কোনও পুলিশ সদস্য সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির না হলে তার অনুপস্থিতির বিষয়টি তার ইউনিটকে প্রতিবেদন আকারে জানাতে হবে। সাক্ষ্য প্রদানের জন্য অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের অনুপস্থিত থাকার কারণ অনুসন্ধান করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় ব্যবস্থা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

কোনও পুলিশ সদস্য আদালতে যথাযথভাবে সাক্ষ্য না দিলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউনিটকে অবহিত করতে হবে। অনুপস্থিত থাকা ও যথাযথভাবে সাক্ষ্য প্রদান করেননি, এ ধরনের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি মাসের ৫ তারিখে পুলিশ সদর দফতরে পাঠাতে হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, কেউ যদি কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই, নিজস্ব গাফিলতির কারণে সাক্ষ্য দিতে হাজির না হন তাহলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। যেকোনও মামলার দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পুলিশ সাক্ষীদের ধার্য দিনে উপস্থিত থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেকোনও মামলা রুজু হওয়া থেকে বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেক মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পুলিশ বাদীও হন। এছাড়া অভিযানের সময় সঙ্গীয় পুলিশ সদস্যদের অনেকেই সাক্ষী হয়ে থাকেন। এজন্য আদালতের বিচার সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সাক্ষ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক সময় পুলিশ সাক্ষীরা আসামি পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে সাক্ষ্য দিতেও গড়িমসি করেন, অনেকেই মিথ্যা সাক্ষ্যও দেন। এ জন্যই পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মামলার নন-পুলিশ সাক্ষীদের কোর্ট ইন্সপেক্টরের অধীন কোনও কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা সম্পর্কে ভালো করে ব্রিফ করতে হবে। পুলিশ বাদী হয়ে রুজু করা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সাক্ষীদের (বাদী) কোর্টে দেওয়া জবানবন্দি ও মামলার এফআইআর-এ প্রদত্ত ঘটনার বিবরণে তারতম্য থাকলে সেসব চিহ্নিত করে ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রসিডিং চালু করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা বা সাক্ষী হিসেবে থাকেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য হয়তো অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকেন কেউ। কিন্তু আদালতে গিয়ে পুলিশ সাক্ষীদের হয়রানির শিকারও হতে হয়। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বিচারকার্য বিলম্ব করতে সাক্ষ্য নেওয়ার নতুন তারিখের আবেদন করেন। কয়েকবার ঘুরে সাক্ষ্য না দিতে পেরে অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সব মামলাতেই পুলিশ সাক্ষী অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ সাক্ষ্যের দুর্বলতার কারণে অনেক সময় গুরুতর অপরাধীরাও আদালত থেকে ছাড় পেতে পারে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সম্প্রতি আশুলিয়া থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার যথাযথ সাক্ষ্য না দেওয়ায় বেতন কাটা হয়েছে।