দাম পরিশোধে ব্যর্থ বিপিসি, জরিমানা ও তেল বন্ধের হুমকি বিদেশিদের

|সাজ্জাদ হোসেন|

গত বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া ডলার-সংকটের রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ডলারের অভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। বিলম্বে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য গুনতে হচ্ছে জরিমানা। শুনতে হচ্ছে তেল সরবরাহ বন্ধ এবং জরিমানা অনাদায়ে আইনি ব্যবস্থার হুমকি।

বর্তমানে ছয়টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া, চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক, দুবাইভিত্তিক এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি, ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি জাপিন, পেট্রোচায়না ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন। এর মধ্যে ভিটল এশিয়া ও ইউনিপেক বকেয়া পরিশোধ না করলে বিপিসিকে আর তেল দেবে না জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া বিলম্বে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য ধার্য করা জরিমানা আদায়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছে পেট্রোচায়না।

পেট্রোচায়না বিপিসির অন্যতম বড় তেল সরবরাহকারী। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই কোম্পানিটি তেলের টাকা ঠিক সময়ে পরিশোধ না করায় বিপিসিকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ২৯৪ ডলার জরিমানা করেছে। এই জরিমানা আদায়ের জন্য গত ২৯ মে বিপিসিকে চিঠি দিয়েছে তারা। চিঠিতে ২ জুনের মধ্যে এই জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে অর্থ পরিশোধ না করলে বিপিসির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুমকি দেয় তারা।

পেট্রোচায়নার হুমকির বিষয়ে জানতে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনি যে বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন, সেটা স্পর্শকাতর বিষয়। আমি এই বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’

একই বিষয়ে কথা বলতে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিপিসির হিসাব বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের মাঝামাঝি যখন দেশে ডলার-সংকট দেখা দেয়, তখন সরবরাহকারীদের ‘দিচ্ছি-দেব’ করে বুঝিয়ে বকেয়া রাখা যেত। এখন তেল সরবরাহকারীরা আমাদের কথায় আর আস্থা রাখতে পারছে না। তাদের সন্দেহ, বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের পাওনা পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ জন্য তারা এখন জরিমানা করা শুরু করেছে। একই সঙ্গে জরিমানার টাকা আদায় করার জন্য আইনি ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছে।

জানা যায়, বিপিসি পেট্রোচায়নার কাছ থেকে গত মার্চ মাসে এক কার্গো ডিজেল কেনে। এমটি সানানা নামে ডিজেলবাহী কার্গো জাহাজটি বাংলাদেশে নোঙর করে ১১ মার্চ। আর ১৫ মার্চ কার্গো থেকে ডিজেল খালাস করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, জাহাজ থেকে তেল খালাসের ৩০ দিনের মধ্যে সরবরাহকারী কোম্পানিকে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সেই হিসাবে ৩ এপ্রিল আমদানি করা ডিজেলের পুরো দাম পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ডলার-সংকটের কারণে বিপিসি সেই অর্থ পরিশোধ করে চার কিস্তিতে। সর্বশেষ কিস্তি দেওয়া হয় গত ২২ মে।

এদিকে কিস্তিতে দাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও যথাসময়ে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় স্বাক্ষরিত চুক্তির ১০ নম্বর ধারা উল্লেখ করে ডিজেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি এখন বিলম্বের জন্য ১০ শতাংশ জরিমানা করেছে বিপিসিকে। এই ১০ শতাংশের মধ্যে আছে জেপি মর্গান চেইস ব্যাংকের ৮ শতাংশ প্রাইম রেট এবং অপরিশোধিত বিলের ওপর ২ শতাংশ।

৩ লাখ ১৪ হাজার ২৯৪ ডলার জরিমানা

তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোচায়নার মোট পাওনা ২ কোটি ৯০ লাখ ২৯ হাজার ৭৮৭ ডলারের মধ্যে গত ৮ মে আংশিক ১ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ করে বিপিসি। এ ক্ষেত্রে ৩৫ দিন বিলম্বের জন্য জরিমানা গুনতে হচ্ছে ২ লাখ ৮২ হাজার ২৩৪ ডলার। প্রথম কিস্তি পরিশোধের পর বাকি ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ২৯ হাজার ৭৮৭ ডলার। গত ১১ মে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৯০ লাখ ডলার পরিশোধ করে বিপিসি। এ ক্ষেত্রেও তিন দিন বিলম্বের জন্য ১৪ হাজার ১৯১ ডলার জরিমানা ধরেছে পেট্রোচায়না। দুই কিস্তি পরিশোধ করার পর আরও বকেয়া থাকে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৭৮৭ ডলার, যার মধ্যে ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয় গত ১৮ মে। তৃতীয় কিস্তির ক্ষেত্রেও ৭ দিন বিলম্বের জন্য ১৫ হাজার ৬১৩ ডলার জরিমানা করে পেট্রোচায়না। এরপর ২২ মে চতুর্থ কিস্তিতে ২০ লাখ ২৯ হাজার ৭৮৭ ডলার পরিশোধ করে বিপিসি। এ ক্ষেত্রে চার দিনের জন্য ২ হাজার ২৫৫ ডলার জরিমানা করে পেট্রোচায়না। এখন এই জরিমানা আদায়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিচ্ছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানিটি।

এখনো বকেয়া ৪৫ কোটি ডলার

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত বিপিসির কাছে তেল সরবরাহকারীদের পাওনার ছিল প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এরমধ্যে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক ভিটল এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক ভুমি সিয়াক পুসাকো এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক নিয়ে এই তিনটি কোম্পানি পাবে প্রায় ৪০ কোটি ডলার।

গতকাল বিপিসি তেলের দামবাবদ প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ  ডলার  দেনা শোধ করেছে। তেল সরবরাহকারীদের হুমকির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের চেয়ে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়েছে। আগে দিনে ১ কোটি ডলার দেওয়া হলেও এখন ২ কোটি ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।