রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের ঘাটতি প্রকট

| লোটন একরাম |

আমরা রাজনীতি করি। গণতন্ত্রের কথা বলি। দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠা করতে চাই। অথচ নিজেদের দলেই গণতন্ত্র চর্চা করতে পারি না। দলীয় প্রধান বা প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দ্বিমত করলেই কোণঠাসা বা পদচ্যুত। এই চিত্র কেন্দ্র থেকে তৃণমূল– সর্বস্তরেই।

দলে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে কীভাবে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব?– এসব কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। পদ হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে সাহস পান না তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনও বলছেন, দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট চলছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ কোনো দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা। বিভিন্ন গবেষণাপত্রেও উঠে এসেছে একই ধরনের বক্তব্য।

অবশ্য দলের শীর্ষ নেতারা দাবি করেন, দলে গণতান্ত্রিক চর্চা হয়ে থাকে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই দলের নেতৃত্ব নির্বাচন ও নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে নেতাদের কেউ কেউ দলে গণতন্ত্র চর্চার অভাবের কথা স্বীকার করেন। তারা মনে করেন, দলীয় প্রধানদের একক সিদ্ধান্তের কারণে অনেক ভুল হয়ে থাকে। এর খেসারত দল ও জনগণকেই দিতে হয়।

গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চার কথা সংবিধানে যেমন রয়েছে, তেমনি ছোট-বড় সব দলের গঠনতন্ত্রে রয়েছে। বাস্তবে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব সব দলেই। বড় দলগুলোয় ‘একনায়কত্ব’ বা ‘কর্তৃত্ববাদী’ চর্চা প্রকট হচ্ছে। ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ ও সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’– এমন স্লোগান ধারণ করলেও প্রকৃতপক্ষে বহুমতের স্থান নেই দলগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছরেও দেশে ও দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই ব্যর্থতার আক্ষেপ রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও। আর আন্তঃদলীয় সম্পর্ক তো দা-কুমড়া অবস্থা। বিরোধীদের সভা-সমাবেশও সহ্য করতে পারে না ক্ষমতাসীনরা।

গণপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী, কোনো দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। দলে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে অন্যতম শর্ত হচ্ছে, দলের সব পর্যায়ের কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যকে নির্বাচিত হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না।

গবেষণায়ও উঠে এসেছে গণতন্ত্র চর্চার অভাবের কথা

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ২০১৫ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেন। এতে প্রধান দুটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার প্রকট অভাবের কথা বলা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার প্রসঙ্গে বেশ কিছু সুপারিশ করেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে– রাজনৈতিক দলগুলোতে অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করতে হবে। দলগুলোকে গঠনতন্ত্র ও নিবন্ধনের আইনগত শর্ত অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে। রওনক জাহান বলেছেন, এসব বাস্তবায়নে সব বড় দলের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের সহযোগিতার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। সংস্কারের মাধ্যমে দলগুলোতে সব আইনকানুন ঠিক করা প্রয়োজন হলেও বর্তমান নেতৃত্বে সম্ভব নয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ‘দ্য স্টেট অব গভর্ন্যান্স বাংলাদেশ ২০১৩, ডেমোক্রেসি পার্টি পলিটিকস’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, দেশের বৃহৎ দল দুটির মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার ‘একান্ত অভাব’ রয়েছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে গঠনতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্য আলোচনা হলেও বিএনপিতে এ বিষয়ে তাদের গঠনতন্ত্র তেমন সুবিন্যাসিত নয়। বড় দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব দিন দিন প্রকট হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশ ও জনগণের ওপর। দলগুলোর গঠনতন্ত্রে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরির কথা বলা থাকলেও তা অকার্যকর। ‘একচেটিয়া’ নেতৃত্ব দেশ ও সরকারের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের ভূমিকা হয়ে যায় গৌণ। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সহনশীলতা থাকলে সংঘাতের রাজনীতিও থাকত না। কিন্তু কোন দল কীভাবে ক্ষমতায় যাবে কিংবা কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকবে, সেই চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এতে বাড়ছে সংঘাত ও সহিংসতা।

দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ দিক হলো, ৪০ বছর ধরে বড় দু’দলের প্রধান একই ব্যক্তি। সব দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দলের উপযোগী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ এখনই খোঁজা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্টজন।

অভিন্ন চিত্র আ’লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে

রাজনৈতিক দলগুলোর বড় দুর্বলতা হলো দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা হয় না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি– প্রতিটি দলের গঠনতন্ত্রে সভাপতি নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বংশানুক্রমিকভাবে মনোনীত নেতারাই দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য পদেও নির্বাচন হয় না। শীর্ষ নেতারাই তাদের ইচ্ছামতো এসব পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটির নেতৃত্ব সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ সমকালকে বলেন, তাদের দল গণতান্ত্রিকভাবেই চলছে। দলে বহুমত থাকার কারণেই একই নির্বাচনী আসনে ২০ জন প্রার্থীও মনোনয়নের জন্য লড়ছেন। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনেক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। তবে কত দিন, এ চর্চা থাকবে জানি না! অন্য দলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, আজকাল কারও মেয়ের বিয়েতে দাওয়া দেওয়ার আগে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর সম্মেলন করার নিয়ম থাকলেও তা করতে পারছে না বিএনপি। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকেও সময় বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা থাকলেও মূলত দলীয় প্রধানের পছন্দেই পদবণ্টন হয়ে থাকে। নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, প্রতি সপ্তাহে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা করেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব সিদ্ধান্ত হয়। গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সম্মেলন না হওয়ার যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ৪৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাসহ নানা অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে সম্মেলন করাও সম্ভব হচ্ছে না। সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন সম্ভব না হলেও আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হচ্ছে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের অবারিত ক্ষমতা রয়েছে। চেয়ারম্যান যে কাউকে পদ দেওয়া, বহিষ্কার এমনকি নিজের পদও আরেকজনকে দিতে পারেন। দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ সমকালকে বলেছেন, কোনো দলেই প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা হয় না। দলীয় প্রধানের ইচ্ছায় দল চলে। জাতীয় পার্টিও এই রীতির বাইরে নয়। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেও দলীয় প্রধানের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা দিতে হয়। তা না হলে দল ভাঙার ঝুঁকি থাকে।

 চেয়ারম্যানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকা প্রসঙ্গে ফিরোজ রশীদ বলেন, অন্যান্য দলের গঠনতন্ত্রে এমন ধারা না থাকলেও পরিস্থিতি একই রকম।

সব ক্ষমতা কুক্ষিগত– দাবি বিশ্লেষকদের

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, দেশে যে গণতন্ত্রের সংকট চলছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ কোনো রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা না থাকা। নাম মনে রাখার মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সভানেত্রী/সভাপতি বা দলীয় প্রধান পদে ৪০ বছর ধরে কোনো পরিবর্তন নেই। মেঠো বক্তব্যে, পোস্টারে ও স্লোগানে গণতন্ত্র আছে– বাস্তবে দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা নেই বললেই চলে। একক নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় মডেল– জেলা এবং মাঠ পর্যায়ে একক ব্যক্তি বা একক পরিবারের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে। ফলে কোনো পর্যায়েই গণতন্ত্র চর্চা হয় না।

দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, এক দল অন্য দলের ব্যাপারে যে ভাষায় কথা বলে, সেটা মধ্যযুগীয় ভাষা। যেসব কথাবার্তা হয়, তা শুনতে বেশির ভাগ সময় লজ্জা লাগে। যারা এ ধরনের ভাষায় এবং অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলেন, তারা জাতীয় নেতা কীভাবে হলেন– সেটাই বড় প্রশ্ন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, দেশে বড় দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চা নেই। রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র চর্চা না হলে রাষ্ট্রেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। এর পরিণতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়, আগে জনগণকে গণতন্ত্র সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সে দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই। কাজেই রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা অপরিহার্য। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে যদি সুসম্পর্ক না থাকে, সহনশীল না হয়, শ্রদ্ধাবোধ না থাকে– তাহলে শান্তি-সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বন্দ্ব ও হানাহানি সৃষ্টি হয়; সার্বিক উন্নয়ন কার্যাবলিও বাধাগ্রস্ত হয়।

সূত্র: সমকাল