বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য জানাচ্ছে যে ২০২২-২৩ বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানির বিপরীতে দেশে এসেছে মোট ৪ হাজার ৩৫৬ কোটি মার্কিন ডলার (প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩)। অর্থাৎ এ সময়ে ১ হাজার ১৯৯ কোটি বা প্রায় ১২শ কোটি ডলারই দেশে আসেনি, যা মোট রফতানিকৃত পণ্যমূল্যের ২১ দশমিক ৫৮ (প্রায় ২২) শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে নানা পথ ও প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, এ ঘটনাকে সে ধরনের অভিযোগের আওতাধীন একটি সম্ভাব্য প্রমাণক মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। উল্লিখিত ১২শ কোটি ডলারের সবটাই হয়তো পাচার হয়ে যায়নি। তবে এর একটি বড় অংশ যে অবশ্যই পাচার হয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের বা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের আয় দেশে আসেনি, সে-সংক্রান্ত সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা সত্ত্বেও তারা কি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? করেনি। বরং এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একই প্রতিবেদনে যুক্ত বিকেএমইএ সভাপতির বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, এ অনৈতিক ঘটনা সংঘটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেরও যথেষ্টই প্রশ্রয় রয়েছে, যা ঘটনাকে পরোক্ষ সমর্থন দানেরই শামিল। বিকেএমইএ সভাপতি বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককেও অনেক দিন ধরে বলছি, ১২০ দিনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারা রফতানি আয় আনছে না তা প্রকাশ করতে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কোনো তথ্য দেয়নি।’ তার মানে হচ্ছে, যারা রফতানি আয় দেশে আনছেন না, তারা সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞাতসারে বা তাদের অলিখিত সম্মতিতেই করছেন। কী ভয়ংকর কথা! অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে, সেখানে উল্টো উদ্যোক্তারাই কিনা রফতানি আয় দেশে না আনা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তালিকা চেয়ে পাঠালে ব্যাংক তা প্রদান থেকে বিরত থাকছে।
কোনো ক্ষেত্রে তা পুরনো অবস্থাকেও বহুলাংশে ছাড়িয়ে যেতে পারবে। উল্লেখ্য, সমস্যায় পড়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা ধার নিয়েছিল, সম্প্রতি তার একটি বড় অংশও তারা বাংলাদেশকে পরিশোধ করে দিয়েছে। এটি শুধু শ্রীলংকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (সিবিসিএল) মুদ্রাভাণ্ডারের ক্রমবর্ধমান সামর্থ্যেরই প্রমাণ বহন করে না, একই সঙ্গে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের সচ্ছলতা ও অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার চেষ্টারও ইঙ্গিতবাহী। এর মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্প্রদায়কে (বিনিয়োগকারী, বাণিজ্য অংশীদার, দাতা ইত্যাদি) শ্রীলংকা এ বার্তাই দিতে চাচ্ছে যে সাময়িক সমস্যা কাটিয়ে ওঠে তারা এখন একটি মর্যাদাবান অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে, যার ওপর সবাই আস্থা রাখতে পারে। বস্তুত অনেকটা সে রকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের মধ্যে কষ্ট করে হলেও বাংলাদেশকে তারা তাদের ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ পরিশোধ করে দিয়েছে।

এই যখন শ্রীলংকার মতো একটি প্রতিবেশী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা, তখন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের পণ্য রফতানির ২২ শতাংশ আয় কেন দেশে ফেরত এল না সে ব্যাপারে প্রায় পুরোপুরিই নির্বিকার (অন্যান্য বছরেও কমবেশি এমনটি হচ্ছে)। এ প্রতিষ্ঠান যার নিয়ন্ত্রণে, সেই মাননীয় অর্থমন্ত্রী খুঁজেই পান না কারা কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার করছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রফতানি আয় দেশে না আনাদের তালিকা চেয়েও তা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তা-সংগঠনের নেতারা। উল্লেখ্য, পণ্য রফতানি আয় দেশে না আনাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় রয়েছে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বিগত অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানিকৃত ১২শ’ কোটি মার্কিন ডলার আয় তারা দেশে আনেননি। আর তাদের এ না আনা অর্থের মধ্যে শুধু তাদের নিজস্ব বিনিয়োগই নেই, রয়েছে সাধারণ মানুষের করের পয়সায় জোগান দেয়া নগদ ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থও। ফলে এর মাধ্যমে তারা শুধু নিজেদের অর্থই পাচার করছেন না, একই সঙ্গে পাচার করছেন এ দেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র সাধারণ জনগণের অর্থও।

এখন কথা হচ্ছে, জনগণের অর্থ কিংবা নিজেদের বিনিয়োগ সেটি যা-ই হোক না কেন এভাবে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেয়ার কাজটি ঠেকানোর কোনো উপায় রাষ্ট্রের হাতে নেই—এটি কোনো গ্রহণযোগ্য ধারণা হতে পারে না। আসল ঘটনা হচ্ছে, রাষ্ট্র সেটি ঠেকাতে চায় কিনা। যদি চায়, তাহলে এ পর্যন্ত যেসব উদ্যোক্তা পণ্য রফতানি আয় দেশে আনেননি, এখন থেকে তাদের সব ধরনের রফতানি সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না? আর মাননীয় অর্থমন্ত্রী যেহেতু তাদের চেনেন না, ফলে এ গোষ্ঠীর একটি তালিকা কি বাংলাদেশ ব্যাংক মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে না?

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার শুধু যে পণ্য রফতানি আয় দেশে না আনার মধ্য দিয়েই ঘটছে, তা নয়। এটি আরো নানাভাবে হচ্ছে, যা নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে। তবে এখানে সীমিত পরিসরে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে রফতানি আয় দেশে না আনাটা অর্থ পাচারের একটি অন্যতম কৌশল এবং তা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে পণ্য রফতানির অর্থ দেশে না আনাসহ অন্য যেসব উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে সেসব এবং মুদ্রা ও আর্থিক নীতির অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে অধিকতর দায়িত্বশীল ও উদ্যমী ভূমিকা পালন করাটা শুধু জরুরিই নয়, অপরিহার্যও বটে। কিন্তু সে ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাহস, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি দেশাত্মবোধ থাকার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি, যা না থাকলে পি. নন্দলাল ভীরাসিংহে কিছুতেই মাত্র ১৮ মাসের ব্যবধানে সে দেশের মুদ্রা পরিস্থিতি ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের বিস্ময়কর পরিবর্তন আনতে পারতেন না। উল্লেখ্য, তার ওই দেশপ্রেমিক নেতৃত্বাধীন মুদ্রা ও আর্থিক নীতির কারণেই শ্রীলংকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০২২ সালে যেখানে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গিয়েছিল, ২০২৩ সালে এসে তা ৩ দশমিক ১ শতাংশে ওঠে এসেছে এবং ২০২৪ সালে তা ৩ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আন্তর্জাতিক প্রক্ষেপণে ধারণা করা হচ্ছে। তো, আমরা কি শ্রীলংকার এত কাছাকাছি থেকেও আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতার সে বোধটি সঞ্চারিত করতে পারি না?

আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত